আহাজারি শোনার কেউ নেই?

কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে অসুস্থ শিশু নিয়ে এক মায়ের আহাজারি। গতকাল দুপুরে।  প্রথম আলো
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে অসুস্থ শিশু নিয়ে এক মায়ের আহাজারি। গতকাল দুপুরে। প্রথম আলো

২৫০ শয্যার কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আবার অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালের একজন চিকিৎসককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় কর্মবিরতি শুরু করেছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আহাজারি করছেন দরিদ্র ও অসহায় রোগীরা। এমনকি জরুরি চিকিৎসা পেতে পর্যন্ত বেগ পেতে হচ্ছে।

এর আগে আরেক চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনায় হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম ৪ এপ্রিল থেকে টানা ৫ দিন বন্ধ থাকার পর গত সোমবার চালু হয়।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, গতকাল সকালে হাসপাতালে ভর্তি একজন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই রোগীর স্বজনেরা হাসপাতালের চিকিৎসক আনিসুল হোসেনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ সময় ইন্টার্ন চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মচারীরা চিকিৎসকের ওপর হামলাকারী মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহকে (৩৮) আটক করে পুলিশে হস্তান্তর করেন। এরপর হামলার প্রতিবাদে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেটে তালা লাগিয়ে কর্মবিরতি শুরু করেন। কয়েক মিনিটের মাথায় হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগেও চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করা হয়।

হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ উদ্দিন খন্দকার বলেন, চিকিৎসকের ওপর হামলাকারী ব্যক্তিকে আটকের পরও চিকিৎসকদের কর্মবিরতি পালন করা ঠিক হচ্ছে না। এতে সাধারণ রোগীরা হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। গরিব রোগীদের আহাজারিতে ভারী হচ্ছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। চিকিৎসকের ওপর হামলাকারী মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহর বাড়ি শহরের সাহিত্যিকা পল্লি এলাকায়। ওসি বলেন, হাসপাতালে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি এবং চিকিৎসকদের লাঞ্ছিত করার অপরাধে আবদুল্লাহকে আটক করা হয়েছে।

 ৪ এপ্রিল ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধর করেন রোগীর স্বজনেরা। এ ঘটনার জের ধরে টানা পাঁচ দিন বন্ধ ছিল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। কর্মবিরতি চলাকালীন চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালের বাইরে কয়েকজন রোগী মারা গেছেন বলেও অভিযোগ আছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র, জেলা প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একাধিক বৈঠক শেষে গত সোমবার বিকেল থেকে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে হাসপাতালে যোগ দেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু রাত পোহানোর পর আরেক চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনায় ফের অচলাবস্থা দেখা দেয় হাসপাতালে।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন, সদর হাসপাতালের সুনাম আছে, সেটা নষ্ট এবং চিকিৎসাব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য তৃতীয় কোনো পক্ষ কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

কক্সবাজার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি নাজিম উদ্দিন বলেন, শহরের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো ইন্টার্ন চিকিৎসক–নির্ভর। ইন্টার্ন চিকিৎসক দিয়ে সরকারি হাসপাতাল অচল করে প্রাইভেট হাসপাতালমুখী করতে রোগীদের বাধ্য করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

হাসপাতালে রোগীর আহাজারি

গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় মারাত্মক দগ্ধ শিশু সুমাইয়াকে (৬) স্বজনেরা নিয়ে আসেন সরকারি এ হাসপাতালে। দেখেন, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে তালা। স্বজনেরা অনেক কান্নাকাটি করলেও চিকিৎসকের সাড়া মেলেনি। সুমাইয়ার প্রাণ বাঁচাতে স্বজনেরা নিয়ে যান পাশের বেসরকারি হাসপাতাল ফুয়াদ আল খতিবে। সেখানে চিকিৎসার বিপরীতে মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়া হয়। এত টাকা হাতে না থাকায় স্বজনেরা সুমাইয়াকে আবার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতালের বাইরে টানা পাঁচ ঘণ্টা সুমাইয়া এবং তার মা কান্নাকাটি করেন। মায়ের আহাজারিতে ভারী হয় পুরো পরিবেশ। বেলা দেড়টার দিকে সুমাইয়াকে নেওয়া হয় জরুরি বিভাগে। এরপর চলে সুমাইয়ার চিকিৎসা।

সুমাইয়া শহরতলির লারপাড়া এলাকার মো. ছলিমের মেয়ে। গতকাল সকাল সাড়ে আটটায় ঘরের রান্নার পাত্রে পা পড়ে দগ্ধ হয় সে।

চিকিৎসকেরা জানান, তার শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসা চলছে।

সুমাইয়াকে হাসপাতালে নিয়ে আসা প্রতিবেশী আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে অনেক তদবির করেছি, জরুরি বিভাগের গেটের তালা খোলানো যায়নি। টানা পাঁচ ঘণ্টা চিকিৎসা না পেয়ে শিশুর অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছিল।’

সুমাইয়ার মতো গতকাল শত শত রোগী চিকিৎসাসেবা না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ছোটেন। কেউ কেউ বিনা চিকিৎসায় বাড়ি ফেরেন।

সকালে সাগর পাড়ি দিয়ে মহেশখালীর শামলাপুর থেকে স্ত্রীকে (প্রসূতি রোগী) নিয়ে সদর হাসপাতালে আসেন আয়াতুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষা করেছি। কিন্তু জরুরি বিভাগের দরজা বন্ধ থাকায় হাসপাতালে ঢুকতে পারিনি। সরকারি হাসপাতালে তালা কেন, তা দেখার লোকও নেই।’

এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বিধান পাল বলেন, বারবার চিকিৎসকের ওপর হামলা চালিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে কেউ ফায়দা হাসিল করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গরিব মানুষ।