কীটনাশকের বিকল্প মেহগনির বীজ

বাড়ির উঠানে বসে ১০ থেকে ১৫ জন নারী-পুরুষ মেহগনির তেল তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ ফল থেকে বিচি আলাদা করছেন, কেউ গুঁড়া করছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই কর্মযজ্ঞ চলার পর তেল প্রস্তুত হলে কাঁধে যন্ত্র আর বালতিতে মেহগনির তেল নিয়ে কৃষকেরা দল বেঁধে চললেন ধানখেতের দিকে। সেখানে গিয়ে পানির সঙ্গে ওই তেল মেশানোর পর ছেঁকে যন্ত্রে ভরা হয়। এরপর নিজ নিজ জমিতে ছিটানোয় লেগে পড়েন।

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার দুটি ইউনিয়নের কৃষকেরা এভাবে কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছেন মেহগনির বীজ থেকে তৈরি তেল। গাছের ডাল পুঁতে (পার্চিং পদ্ধতি) পাখিদের বসার আশ্রয়স্থল করার মাধ্যমেও পোকা দমনের চেষ্টা করছেন তাঁরা। ব্যবহার করা হচ্ছে ফ্রেমন ফাঁদও। একই সঙ্গে কৃষিকাজে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে তাঁরা ব্যবহার করছেন ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো কম্পোস্ট) সার। আর এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তা জীবানন্দ রায়।

উপজেলার উত্তর শৈলমারী বিলে এবার দুই একর জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন অধীন বৈরাগী। প্রতিবছর কীটনাশক ব্যবহার করলেও তিনি এবারই প্রথম ব্যবহার করছেন মেহগনির তেল। তিনি বলেন, প্রথম দিকে ধানে পোকা লাগার পর ওই তেল ব্যবহার করে তিনি ভালো ফল পেয়েছেন। বিশেষ করে এই তেলের প্রভাবে পোকা উড়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসে না। এ ছাড়া পাখিরা সহজে ওই পোকা খেতে পারে। কিন্তু কীটনাশক ব্যবহার করা হলে পাখিরা পোকা খেতে চায় না, অনেক সময় পোকা খেয়ে পাখি মারাও যায়।

আরেক কৃষক রিপন বৈরাগী বলেন, ইঁদুর ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে এবার প্রথমবার মেহগনির তেল ছিটানোর পর তাঁর খেতে ইঁদুর আক্রমণ করেনি। জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ছিটানোর সময় নাক-মুখেও ঢুকে যায়। এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। বিশেষ করে গায়ে একধরনের চুলকানি হয়। কিন্তু মেহগনির তেল ব্যবহারে এসব সমস্যা হচ্ছে না।

বোরো ধানের জমিতে কমপক্ষে তিনবার কীটনাশক ছিটাতে হয়। এতে প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয় কমপক্ষে দেড় হাজার টাকা। মেহগনির তেল ব্যবহার করায় এই খরচ কমে গেছে বলে জানান আরেক কৃষক সুনীল বৈরাগী। তিনি এবার এক একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন।

কৃষকদের কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে এই পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বটিয়াঘাটা উপজেলা কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জীবানন্দ রায়। তাঁর কাজের আওতার মধ্যে রয়েছে উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ও জলমা ইউনিয়ন। এখানকার কৃষকদের তিনি ফসলের পোকা দমনে মেহগনির বীজের তেল ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে জৈব কীটনাশক ছাড়া উপায় নেই। এ জন্য সরকারের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই বালিয়াডাঙ্গার ফুলবাড়ী ও জলমার উত্তর শৈলমারী গ্রামের কৃষকদের কীটনাশকের বিকল্প ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পরামর্শ অনুযায়ী কৃষকেরা কাজও করছেন। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে পেরে তাঁরাও খুশি।

জীবানন্দ জানান, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা অর্গানিক ফিউচার পার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ আবদুল মতিনের কাছ থেকেই প্রথম মেহগনির বীজ ব্যবহারের বিষয়ে ধারণা পেয়েছিলেন তিনি। এরপর গত বছর এই পদ্ধতি কিছু কিছু জায়গায় স্বল্প পরিসরে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। সেখান থেকে ভালো ফল পাওয়ার পর ওই পদ্ধতি সব কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। প্রাথমিকভাবে ওই দুই ইউনিয়নে শুরু করা হলেও পর্যায়ক্রমে তা উপজেলার সব জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানান রবিউল ইসলাম।

মেহগনির বীজ থেকে তৈরি তেল কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা গেলে এটি যেমন সাশ্রয়ী, তেমনি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে তার কিছু অংশ ওই সবজি ও ধানের মধ্যে থেকে যায়, যা পরে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া কীটনাশক ছিটানোর ফলে আশপাশের পরিবেশও নষ্ট হয়। সেসব দিক দিয়ে মেহগনির বীজের তেল বা জৈব সার অনেক উপকারী। এতে ফসলের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। পরিবেশের ওপরও কোনো প্রভাব পড়ছে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার বলেন, দেশে একসময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনই মুখ্য বিষয় ছিল। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর এখন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করার পরিকল্পনা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের জৈব পদ্ধতি নিঃসন্দেহে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের একটি অনুষঙ্গ। ধীরে ধীরে কৃষকদের ওই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত করানোর চেষ্টা করা হবে।