নববর্ষ হোক শুদ্ধির সাধনা

সন্‌জীদা খাতুন
সন্‌জীদা খাতুন

কী যে এক চাঞ্চল্য নিয়ে বাংলা নববর্ষ আসে! সবার মনের ভেতরে অদ্ভুত এক সাড়া জাগায় পয়লা বৈশাখ। সবাই যে উপস্থিত পরিস্থিতির সঙ্গে নতুন বছরের পয়লা বৈশাখের মর্মকথার যোগ ঘটাতে পারে, তা হয়তো নয়। সবাই তো আর সেভাবে ভাবতে পারে না। তবে আমার যেটা ভালো লাগে, তা হলো অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের মানুষটিও স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বেড়াতে বের হয়। পরিচ্ছন্ন জামা পরে। বাড়িতে কিছু নতুন খাবার খায়। সাধারণ মানুষের ভেতরে পয়লা বৈশাখ নিয়ে যে শিহরণটা আছে, সেটা তো বাঙালিয়ানার। আমার বেশ ভালো লাগে। এই যে সবাই মিলে অনন্য বলে মনে করছে দিনটিকে, এটি কিন্তু যে-সে কথা নয়।

আমরা যে সময়ে নববর্ষ পালন করতে শুরু করেছিলাম, তখন এ রকম চেতনা ছিল না মানুষের মধ্যে। সে সময় সবার বুকে ছিল একটা চেপে রাখা অনুভূতি। কী যেন হচ্ছে, কী যেন হচ্ছে। আমি লিখেছিলাম কোথাও, ‘বাতাসে একটা নিষেধ ভাসে’। আমাদের তখন মনে হলো, যা করা দরকার, সেটাই আমরা করব। আমরা ভাবলাম গঠনমূলক কিছু করি। বিদ্যায়তন করি। কারণ, নতুন শিল্পী তৈরি করতে হবে, সংস্কৃতিটাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু। আমরা ভাবলাম, পয়লা বৈশাখের সূত্রে এটি ছড়ানো যাবে আরও বেশি করে। যেহেতু এটা বাঙালির তিথি, একেই তুলে ধরা দরকার।

শুরুতে আমরা এটা করেছি ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনেই। সবাই চাইত নববর্ষের অনুষ্ঠান আলাদাভাবে হোক। আমাদেরই এক বন্ধু বলল, আমরা নববর্ষের অনুষ্ঠান চাই। তখন আমরা ঠিক করলাম, অনুষ্ঠান হবে খোলা জায়গায়। তাহলে বেশি লোক আসতে পারবে, বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে। রমনা বটমূলে এভাবেই নববর্ষের আবাহনের সূচনা ১৯৬৭ সাল থেকে। অত ভোরে যে শুরু হতো, জোহরা তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ভোরে আসতে খুব ভালো লাগে তাঁর। তিনি বসে পড়তেন বেদির পেছন দিকটাতে। এ রকম অনেকে আসতেন। এই যে সবাই এসে যুক্ত হলেন, সবাই মিলে একসঙ্গে অনুভব করলেন যে আমরা বাঙালি, আমাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি আছে, আর তার মধ্যেই আমরা বাঁচি—এমন একটা উপলব্ধি সঞ্চারিত হলো। এভাবেই শুরু হয়। খুব যে বুঝে করেছিলাম, তা বলব না। এখন বুঝি, কাজটার একটা তাৎপর্য ছিল।

ছায়ানটের নববর্ষের অনুষ্ঠানে আমরা সব সময় প্রাসঙ্গিক থাকতে চেয়েছি। যখন যা পরিস্থিতি ছিল, সেই বিষয় ধরেই আমাদের অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা হতো। গান বাছাই হতো সেভাবেই। এখনো আমরা সেটা করি পয়লা বৈশাখে। আমাদের এবারের থিম সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে শুদ্ধির সাধনা।

আমরা গণজাগরণের গান করি। যে গানগুলোতে বাঙালিয়ানা আছে, সেগুলো নিই। নিজেদের প্রয়োজনেই এসেছে নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, গুরুসদয় দত্তের গান। সলিল চৌধুরীর গানও আসে। এবারের পয়লা বৈশাখে নিয়েছি আরও অনেকের গান। কুটি মনসুর সাধারণ একজন মানুষ। তাঁরও একটা গান নিয়েছি। কথায় খুব মাহাত্ম্য না থাকলেও প্রাসঙ্গিকতা আছে—‘মনের ময়লা সাফ করো’। কেন? তাহলে দেখবে, মানুষকে ভালোবাসতে পারবে। এই কথাগুলো আমাদের মধ্যে আসা দরকার।

আমরা সেই জিনিসগুলোই নিই, যার মধ্যে মৌল বাঙালিত্ব থাকে। বাঙালিত্ব হারিয়ে গেলে আর কী থাকে আমাদের? বিশ্বায়ন তো হবেই। কিন্তু আগে তুমি বাঙালি, তারপর বিশ্বের। ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ।’

এখন তো নববর্ষকে আবাহনের এমন অনুষ্ঠান সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। দেশের বহু জায়গায় হচ্ছে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান। পয়লা বৈশাখ মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাদের বাঙালিত্বের কথা।

{প্রথম আলোর সঙ্গে কথোপকথনের শ্রুতলিখনের ভিত্তিতে}