রমনার প্রেমে পড়া সিদ্দিকুরের আবেগী মন

ছায়া ঘেরা রমনা পার্ক। সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে সোনালি রোদ ছুঁয়ে দিচ্ছে সবুজ ঘাস। বটের তলায় ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে ছিলেন এক দল যুবক। মাঝখানে বসেছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। তাঁর বয়স ৫৫ বছর। উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইছিলেন সিদ্দিকুর। 

‘বকুল ফুল বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি...’গান গাওয়ার সময় সিদ্দিকুরের মুখে ছিল নির্মল হাসি। হাত দুখানা ওপরে তুলছিলেন মাঝে মাঝে। আর মনের আনন্দে গাইছিলেন তিনি। তাঁর গান শুনে রমনা পার্কে দুদণ্ড শান্তি নিতে যাওয়া মানুষেরা ভিড় করছিলেন সেখানে। এক গান শেষ হতেই সিদ্দিকুর আবার অন্য গান শুরু করলেন।

‘মধু হই হই বিষ হাওয়াইলা
হন হারনে ভালবাসার দাম ন দিলা...’

রমনায় সিদ্দিকুর রহমান। ঢাকা, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯। ছবি: আসাদুজ্জামান
রমনায় সিদ্দিকুর রহমান। ঢাকা, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯। ছবি: আসাদুজ্জামান

সিদ্দিকুরের গানের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে রমনা পার্কে। পয়লা বৈশাখের দুপুরে সেখানে আসেন আরও একদল যুবক। দাঁড়িয়ে শুনতে থাকেন সিদ্দিকুরের গান, এক সময় গলা মেলান তাঁরাও। একটা গান শেষ হতেই ওঠে অনুরোধ, ‘চাচা, আরেকটি গান গান।’ দরাজ কণ্ঠে সিদ্দিকুর আবার গাইতে শুরু করেন।
‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইক্কুম তোঁয়ারে
সিনার লগে বাঁধি রাইক্কুম তোঁয়ারে, ও ন’নাইরে...’

গান শেষে সিদ্দিকুর পাচ্ছিলেন জোর হাততালি। গাইতে গাইতে একপর্যায়ে সিদ্দিকুর গানের তালে নাচতে শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন পথচলতি গান শোনা যুবকের দল। সিদ্দিকুরের কণ্ঠে তখন—
‘অতীতের কথাগুলো পুরনো স্মৃতিগুলো
অতীতের কথাগুলো ও পুরনো স্মৃতিগুলো
মনে মনে রাইখো...’

গান পাগল সিদ্দিকুর রমনা পার্ককে বড়ই ভালোবাসেন। কাজ করেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবীর সহকারী হিসেবে। ২৬ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি। হাইকোর্টে কাজ শেষে রোজ বিকেলে রমনা পার্কে ঢুঁ মারেন সিদ্দিকুর, হাঁটেন। সিদ্দিকুর প্রথম আলোকে বলেন, রমনা পার্কের প্রেমে পড়েছি বহু আগে। কিন্তু সেই প্রেম আজও শেষ হয়নি। বরং বেড়েছে।

নাচের তালে রমনায় গান গাইছেন সিদ্দিকুর। ঢাকা, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯। ছবি: আসাদুজ্জামান
নাচের তালে রমনায় গান গাইছেন সিদ্দিকুর। ঢাকা, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯। ছবি: আসাদুজ্জামান

সিদ্দিকুর জানান, চার বছর আগে পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছেন। ঢাকায় এখন একা থাকেন তিনি। প্রতিদিনই আসেন রমনা পার্কে। এখানে আসলে তাঁর মন কেমন যেন হয়ে যায়। গান আসে মনে, আপন মনে গেয়ে যান।

রমনা পার্ক নিয়ে সিদ্দিকুর নিজেও গান বেঁধেছেন। আজ রোববার দুপুরে রমনায় যুবকদের শোনান নিজের লেখা গান।
‘বিকেলের ওই সন্ধ্যা বেলায়
রমনার ওই বটতলায়
দেখা হলো তোমার সনে চোখের ইশারায়...’
ছোটবেলা থেকেই সিনেমার পাগল সিদ্দিকুর। সিনেমার বহু গান তাঁর মুখস্থ। শাহ আবদুল করিমসহ আরও অনেকের গান তাঁর ঠোটস্থ। নিজে গান লেখেন, সুরও দেন।

পয়লা বৈশাখে তরুণ-তরুণীর পদচারণে মুখরিত রমনা পার্ক। ঢাকা, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯। ছবি: আসাদুজ্জামান
পয়লা বৈশাখে তরুণ-তরুণীর পদচারণে মুখরিত রমনা পার্ক। ঢাকা, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯। ছবি: আসাদুজ্জামান

পয়লা বৈশাখের প্রথম প্রহরে রমনায় এসেছিলেন সিদ্দিকুর। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আপন মনে গান গেয়ে চলেন। সকাল থেকে সিদ্দিকুর দেখেছেন—দলে দলে নারী-পুরুষ এসেছেন রমনায়। হাতে হাত রেখে ঘুরেছেন রমনার ছায়াতলে।
দেহের বয়স বাড়লেও সিদ্দিকুরের মনের বয়স মোটেও বাড়েনি। সিদ্দিকুর বললেন, গান গাই, গান লিখি। খুব ভালো লাগে। কষ্ট নেই মনে।

রমনার পুকুরপাড় দিয়ে এক দম্পতি হাতে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তা দেখে সিদ্দিকুর জানালেন, প্রেমের গানও তিনি লিখেছেন। সঙ্গে সঙ্গে গাইতে শুরু করলেন নিজের লেখা গান, ‘আমি যে তোমার বন্ধু, তুমি যে আমার...’

বড় আবেগী মন সিদ্দিকুরের। গান গাইবার সময় ভুলে যান সবকিছু। দুই হাত উঁচু করে নাচের তালে গাইতে থাকেন। সিদ্দিকুর নিজের সম্পর্কে বললেন, ‘আমি বড়ই আবেগী মানুষ। আমার সব আবেগ, আমার সব ধ্যানজ্ঞান গানকে ঘিরে। গান গাইতে গাইতে যেন মরতে পারি।’