পাঁচজনে ৫ মিনিটেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান
>

• নুসরাত হত্যার সঙ্গে জড়িত দুই আসামির জবানবন্দি
• দুই আসামি হলেন নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন
• জবানবন্দিতে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে
• পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মাদ্রাসার অধ্যক্ষের নির্দেশে

চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয় ৪ এপ্রিল। কেরোসিন কেনা হয় ৫ এপ্রিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় ৬ এপ্রিল। এদিন পরীক্ষা দিতে এলে কৌশলে মাদ্রাসার তৃতীয় তলা ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয় নুসরাতকে। এরপর কেউ পা বাঁধেন ওড়না দিয়ে, কেউ কেরোসিন ঢেলে দেন পা থেকে বুক পর্যন্ত। অন্য একজন ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন গায়ে। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন পাঁচজন আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময় লেগেছে মাত্র পাঁচ মিনিট। সবই করা হয়েছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার নির্দেশে।

এমন লোমহর্ষক বর্ণনা উঠে এসেছে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যার সঙ্গে জড়িত দুই আসামির জবানবন্দিতে। তাঁরা হলেন মামলার অন্যতম প্রধান আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন। গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে ৬ এপ্রিল তাঁর ওপর অগ্নিসন্ত্রাস চালানোর ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তাঁরা। এই হত্যাকাণ্ডের পর খুনিরা বিষয়টি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন এবং পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলমকে জানিয়েছিলেন। এই খুনের ঘটনায় মাকসুদ এখন কারাগারে। হত্যাকাণ্ডের আগে অধ্যক্ষ ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামের ২০ সদস্যের কমিটির জন্য টাকা দিয়েছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জনৈক কেফায়েত উল্লাহ।

পুলিশ, আইনজীবী ও আদালত সূত্রে পাওয়া জবানবন্দিতে দেখা যায়, পুরো ঘটনায় ২৫–২৬ জন জড়িত। গত রোববার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে দুই আসামিকে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে রাত প্রায় একটা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দুই আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম ২৫ পৃষ্ঠা এবং নুর উদ্দিন ৩০ পৃষ্ঠার জবানবন্দি দেন।

সোনাগাজী ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় ৬ এপ্রিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে তিনি মারা যান ১০ এপ্রিল। এ ঘটনায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সরাসরি জড়িত পাঁচজনের মধ্যে চারজনই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। পালিয়ে আছেন শুধু কামরুন নাহার মণি।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নিশ্চিত করেছে, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম, জোবায়ের আহমেদ, জাবেদ হোসেন, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন এবং কামরুন নাহার ওরফে মণি। মণি ছাড়া চারজনই গ্রেপ্তার হন। তাঁদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন ফেনীর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

শাহাদাত হোসেন মাদ্রাসা কমিটি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বলে দাবি করেছেন। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, মাদ্রাসায় ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। অধ্যক্ষ সিরাজ জামায়াতের রুকন।

শাহাদাতের জবানবন্দি
নুসরাতকে হত্যার বিষয়ে গোপন বৈঠক হয় ৪ এপ্রিল রাতে। শাহাদাত ছাড়াও বৈঠকে ছিলেন নুর উদ্দিন, হাফেজ আবদুল কাদের, জাবেদ, জোবায়ের, মহিউদ্দিন শাকিল, শামীম (২), ইমরান, ইফতেখার হোসেন রানা ও শরীফ। হত্যা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন শাহাদাত, নুর উদ্দিন ও কাদের। নুসরাত মাস দেড়েক আগে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হন শাহাদাত। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়, ৫ এপ্রিল আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষার দিন নুসরাতকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হবে। থানা–পুলিশের বিষয়টি মাকসুদ (ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা) এবং রুহুল আমিন (উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) দেখবেন। সিদ্ধান্ত হয় শাহাদাত, জোবায়ের, জাবেদ, ও মণি সাইক্লোন শেল্টারের (তৃতীয় তলা ভবন) ছাদে থাকবেন। মণি তাঁর বাড়ি থেকে তিনটি বোরকা নিয়ে আসবেন। কেরোসিন আনবেন শাহাদাত। আর নুসরাতকে কৌশলে ডেকে আনবেন উম্মে সুলতানা পপি। গেটে অবস্থান নেবেন আফসার ‘স্যার’, গেটের বাইরে নুর উদ্দিন, হাফেজ কাদের, ইমরান হোসেন মামুন ওরফে ইমরান, ইফতেখার হোসেন ওরফে রানা, মো. হোসেন ওরফে শরীফ। সাইক্লোন শেল্টারের নিচে পাহারায় থাকবেন মহিউদ্দিন শাকিল ও শামীম (২)।

জবানবন্দিতে শামীম বলেন, ‘বিষয়টি মাকসুদ কাউন্সিলর, আফসার স্যার, সেলিম স্যার, হুজুরের (অধ্যক্ষ) দুই ছেলে নিসু ও আদনান, মণি এবং পপিকে জানানোর দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর এবং সেই দায়িত্ব পালন করি। আমরা তখন তৃতীয় তলার একটি কক্ষে ছিলাম। নুসরাতকে নিয়ে পপি ছাদে উঠলে আমরা চারজন দ্রুত তাঁর কাছে চলে যাই। এরপর মণি ও পপি ধরে ফেলে নুসরাতকে। তখন আমি নুসরাতের মুখ চেপে ধরি। জোবায়ের নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে হাত–পা বেঁধে ফেলে। আমরা নুসরাতকে ছাদে শুইয়ে ফেলি। আমি নুসরাতের মুখ চেপে মাথা ধরে রাখি। মণি তাঁর বুক ধরে রাখে। পপি পা ধরে রাখে। এ সময় পপি পরিকল্পনামতো শম্পা বলে ডাক দেন। আসলে পপির ছদ্মনাম শম্পা। আর জাবেদ পলিব্যাগে থাকা কেরোসিন নুসরাতের পা থেকে বুক পর্যন্ত ঢেলে দেয়। জোবায়ের ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়। এতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ মিনিট। ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন দিলে তা দ্রুত গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আমি, জাবেদ ও জোবায়ের বোরকা খুলে ফেলি। আমি প্রস্রাবখানার পাশ দিয়ে বের হয়ে যাই। জাবেদ মাদ্রাসার হোস্টেলে ঢুকে যায়। মণি ও পপি ওরফে শম্পা পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। কারণ, তাঁরা দুজনই নুসরাতের মতো আলিম পরীক্ষার্থী।’

জবানবন্দিতে শামীম বলেন, ঘটনার পর তিনি রুহুল আমিনকে (উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) জানান এবং ময়মনসিংহে পালিয়ে যান। পরে মুক্তাগাছায় গ্রেপ্তার হন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি। মাদ্রাসার বিষয়ে অনেকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠার পর তিনি তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেন বলে দাবি করেন।

পিবিআইয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, শ্লীলতাহানির ঘটনায় মামলা হলে একজন ব্যাংকার অধ্যক্ষের পক্ষে আন্দোলন করতে টাকার জোগান দেন। এ ছাড়া পরিকল্পনার কথা অধ্যক্ষের দুই ছেলেও জানতেন।