চোখের পানি শুকায় না মনিরের মায়ের

নিহত সন্তান মনিরের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন মা। কোলে আরেক সন্তান মাইশা।  ছবি: প্রথম আলো
নিহত সন্তান মনিরের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন মা। কোলে আরেক সন্তান মাইশা। ছবি: প্রথম আলো

‘আজান দিলেই বাপজানে দৌড়াইয়া মসজিদে যাইত। আর ফজর ওয়াক্তে সবার আগে ঘুম থেকে উইঠা বইয়া থাকত। মাদ্রাসায় যাওনে কোনো না ছিল না। বাপজানরে চাইছিলাম হুজুর বানাইতে, কিন্তু আহন বেবাক শেষ হইয়া গেছে।’

সাত বছরের সন্তান মনিরকে হারিয়ে বিলাপ যেন থামতেই চায় না মা কল্পনা বেগমের। সন্তানের পোশাক, বইখাতা আর স্মৃতির টুকরো নিয়ে কাটে তাঁর সারা দিন। হত্যার ৯ দিন পেরিয়ে গেছে, চোখের পানি শুকোচ্ছে না পুত্রহারা মায়ের।

৮ এপ্রিল বিকেলে ডেমরায় মসজিদুল-ই-আয়েশা জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলা থেকে তৃতীয় তলায় ওঠার সিঁড়িতে সিমেন্টের বস্তার ভেতরে রশি দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় আট বছরের শিশু মনির হোসেনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

বড় দুই বোনের সঙ্গে বাসার পাশেই নুর-ই মদিনা মাদ্রাসায় পড়ত মনির। ৭ এপ্রিল সকালে তারা মাদ্রাসায় যায়। সেখান থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। পরে তার বাবা সাইদুল হকের কাছে ফোন দিয়ে তিন লাখ টাকা দাবি করে অপহরণকারীরা। এক লাখ টাকা জোগাড় করে তাদের কথামতো মসজিদুল-ই-আয়েশা জামে মসজিদে রেখে আসেন সাইদুল হক। পরদিন শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

 ডেমরা থানার কোনাপাড়া ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) শাহ্‌ আলম জানান, এ ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুল জলিলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি পুলিশের কাছে অপহরণ ও খুনের ঘটনা স্বীকার করেছেন। তাঁর সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্র নূরানী বিভাগের ছাত্র আহমেদ শফি তোহা ও মো. আকরাম নামের আরেকজন জড়িত ছিল। পরে পুলিশ তাদের দুজনকেও গ্রেপ্তার করে। অধ্যক্ষ আবদুল জলিল ও আকরাম এখন কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। আহমেদ শফি তোহাকে টঙ্গীর কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

ডেমরার ডগাইর এলাকার নতুন পাড়ায় একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে মনিরের পরিবার। বাবা সাইদুল হক ছোট ব্যবসায়ী। গত সোমবার সরু গলি দিয়ে বাসায় ঢুকতেই দেখা গেল বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী মনিরের মা কল্পনা আক্তারের পাশে বসে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু পুত্র হারানোর শোক লাঘব হচ্ছিল না তাতে। কিছুক্ষণ পরপর তিনি বিলাপ করে বিচার চাইছিলেন নিরপরাধ শিশুপুত্র হত্যার।

শিশু মনিরের তিন বোন। বড় দুই বোন ফাতেমা আক্তার ও মরিয়ম আক্তারের সঙ্গে প্রতিদিন সে সকালে মাদ্রাসায় যেত। ছোট ভাইকে হারিয়ে তারাও
মনমরা হয়ে আছে। ভাইকে মনে পড়লে কাঁদতে থাকে মায়ের সঙ্গে। আর আড়াই বছরের ছোট বোন মাইশা ভাইয়ের ছবি বুকে আঁকড়ে বসে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে মায়ের কাছে ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করে। কী উত্তর দেবেন মা?

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এখন কেবলই তার স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন কল্পনা। মনিরের জামা হাতে নিয়ে ছেলের স্পর্শ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ছেলের খেলনাগুলো হাতড়ে হাতড়ে ছেলের স্মৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। খেলনাগুলো হাতে নিয়ে কল্পনা বেগম বলেন, ‘বাপজানে মাদ্রাসার তে আইসাই এই খেলনাগুলা নিয়া বসত। কখনো পুলিশ আবার কখনো ডাক্তার হতে চাইত।’

মনিরের বাবা সাইদুল হকের ব্যাগ তৈরির কারখানা বাসার পাশেই। দুর্ঘটনার পর থেকে কারখানা বন্ধ। থানা-পুলিশ করতে করতেই সারা দিন কাটে সাইদুলের। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে কোনো আলেম নাই। আমার তিনটি মেয়ে, আর একটা মাত্র ছেলে ছিল। ছেলে হওয়ার পরই আমি নিয়ত করেছিলাম বড় আলেম বানাব। মাদ্রাসায় দিলাম। কিন্তু সেখানকার শিক্ষকই আমার ছেলেটারে শেষ করে দিল। আমার মতো আর কারও বাবার বুক যাতে খালি না হয়, সেই কামনাই করি। আর এই খুনির দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’