অরক্ষিত সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি

>

সড়কে বিভাজকের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ইউটার্ন নিচ্ছে বাস। টঙ্গী ফায়ার সার্ভিস এলাকায়।  প্রথম আলো
সড়কে বিভাজকের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ইউটার্ন নিচ্ছে বাস। টঙ্গী ফায়ার সার্ভিস এলাকায়। প্রথম আলো

দিন দিন ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। আবার কখনো তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের টঙ্গী থেকে সালনা পর্যন্ত সড়ক অরক্ষিত। যত্রতত্র গাড়ি ঘোরানো (ইউটার্ন), তিন চাকার যান চলাচল, রাস্তার মাঝে বাসে যাত্রী ওঠানো-নামানোসহ নানান বিশৃঙ্খলা চলছে। এতে দিন দিন মহাসড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। আবার কখনো তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যত্রতত্র গাড়ি ইউটার্ন নেওয়ার প্রধান কারণ বিভিন্ন জায়গায় সড়ক বিভাজকে কাটা (অবৈধ ইউটার্ন)। ট্রাফিক পুলিশের যথাযথ তদারকি না থাকায় অবাধে চলছে তিন চাকার যান। আর মাঝপথে যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য। তা ছাড়া যানজট এড়িয়ে মূল গন্তব্যে যেতে নারাজ অনেক গাড়ির চালক।

যাত্রীদের অভিযোগ, চালকের লাইসেন্স বা অন্যান্য কাগজপত্র ঠিক আছে কি না, সে বিষয়ে তদারক করা হচ্ছে না। কিন্তু যেখানে-সেখানে গাড়ি ঘোরানো, তিন চাকার যান চলাচল আর মাঝপথে যাত্রী নামিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ উদাসীন।

গত বছরের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অনেক দিন আটকে থাকা সড়ক পরিবহন আইনটিও পাস হয়। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। এ বিষয়ে গাজীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো. এনায়েত হোসেন বলেন, ‘এই রাস্তায় এখন উন্নয়নকাজ চলছে। এ জন্য একটু যানজটও হয়। তারপরও আমাদের মোবাইল টিম থাকে।’

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, টঙ্গী পদচারী–সেতুর নিচ থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়ক বিভাজকের ১৮ জায়গায় কাটা। এর মধ্যে টঙ্গী বাজার থেকে স্টেশন রোড পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মিটার সড়কে তিন জায়গায় কাটা। এ ছাড়া কামারপাড়া রোড, চেরাগ আলী, টঙ্গী পৌরসভা, কলেজ গেট, গাজীপুরা ২৭, বোর্ডবাজার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৫টি জায়গায় বিভাজকে কাটা আছে। এগুলো দিয়ে যখন-তখন ইউটার্ন নিচ্ছে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ ছোট–বড় যানবাহন। যানবাহনের প্রতিটি ইউটার্নে সড়কে তৈরি হচ্ছে যানজট।

গত ২১ মার্চ সকালে টঙ্গী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সামনের সড়ক বিভাজকের কাটা (ইউটার্ন) জায়গাটিতে অবস্থান করে দেখা যায়, সকাল ১০টা ৫ থেকে ১০টা ৪৫ পর্যন্ত ৪০ মিনিটে ১৬টি গাড়ি মোড় নেয় (ইউটার্ন) এই ফাঁকা দিয়ে। এর মধ্যে প্রতিটি ইউটার্নে সড়কে তৈরি হয়েছে এক থেকে দেড় মিনিটের যানজট। জানতে চাইলে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্য মো. আরিফ বলেন, ‘আমরা এখানে গাড়িকে মোড় নিতে নিষেধ করি। আমাদের কথা কেউ শোনে না।’

জানা যায়, ২৬ নভেম্বর এই ইউটার্নের কারণে প্রাণ যায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রের। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে রাস্তা পার হওয়ার জন্য টঙ্গী পৌরসভার সামনের অবৈধ ইউটার্নে অবস্থান করছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইইউবিএটির শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। একটি কাভার্ড ভ্যান হঠাৎ ডান দিকে ইউটার্ন নিতে গেলে চাকার নিচে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ওই শিক্ষার্থী।

সম্প্রতি টঙ্গী থেকে সালনা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় অবাধে চলছে রিকশা, ইজিবাইক, অটোরিকশাসহ তিন চাকার অন্যান্য যান। এর মধ্যে টঙ্গী সেতু, টঙ্গী বাজার, কলেজ গেট, এরশাদনগর পদচারী–সেতুর নিচে, বোর্ড বাজারসহ ৫-৬টি জায়গা থেকে এসব তিন চাকার যানবাহন চলাচল করছে। তা ছাড়া চান্দনা চৌরাস্তা থেকে সালনা পর্যন্ত সড়কের আরও ২-৩টি জায়গায় চলছে এসব ধীরগতির যানবাহন। গত ২৩ মার্চ সড়কটির সালনা এলাকায় উল্টো পথে আসা অটোরিকশার সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী। জানা যায়, মোটরসাইকেলে করে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিল নাছির, রবিন ও আলামিন নামের তিন বন্ধু। সালনা এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি অটোরিকশার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় মোটরসাইকেলের। মহাসড়কে ছিটকে পড়লে ময়মনসিংহগামী শৌখিন পরিবহনের একটি বাস নাছিরকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় নাসির। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায় রবিন।

২১ মার্চ রাজধানীর মালিবাগ থেকে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন মায়া চৌধুরী। তাঁর গন্তব্য নরসিংদীর ঘোড়াশাল। তাঁকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার কথা টঙ্গী স্টেশন রোডে। কিন্তু বাসটি টঙ্গী আনারকলি রোডের সামনে এসে সব যাত্রীকে নামিয়ে দেয়। এরপর হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন প্রায় ৮০ বছরের এই নারী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরা আমার কোনো কথাই শুনল না। তাই একটু জিরাই জিরাই (বিশ্রাম) হাঁটছি।’

গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ‘যেসব জায়গায় কাটা (ইউটার্ন) আছে তা বন্ধ করার একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে আমরা কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘যেসব গাড়ি নির্ধারিত জায়গায় মোড় না নিয়ে যেখানে-সেখানে ঘুরছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সব সময়ই মামলা দিচ্ছি।’