নুসরাত হত্যা: পুলিশের ভূমিকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি

নুসরাত জাহান।
নুসরাত জাহান।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের হত্যাকাণ্ডে পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও যোগসাজশের যে অভিযোগ উঠেছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আজ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।

টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা সংখ্যা ও নৃশংসতার মাত্রা এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা অকল্পনীয়। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে দায়ী ব্যক্তি ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোরতম প্রয়োগ নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাশিত দ্রুততায় এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারাই যথেষ্ট নয়, উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলা ও যোগসাজশের যে অভিযোগ উঠেছে, তাতে আমরা আতঙ্কিত। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ওই পুলিশ কর্মকর্তা নুসরাতের অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেননি, বরং অভিযোগটির সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি নুসরাতকে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পরও ওই পুলিশ কর্মকর্তা একে আত্মহত্যার চেষ্টা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেছেন। মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রেও ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সব অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তথা সার্বিকভাবে পুলিশ প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এ জন্য আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।’

পুলিশের নিজস্ব তদন্ত এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘একজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে, অথচ এরই মধ্যে ফেনীর পুলিশ সুপার লিখিতভাবে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের পক্ষ নিয়েছেন। সুতরাং পুলিশের এই তদন্ত কতটা কার্যকর হবে সে ব্যাপারে আমরা একেবারেই আশ্বস্ত হতে পারছি না। শুধু সংশ্লিষ্ট থানা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়াটা কোনো শাস্তি হতে পারে না। দোষীরা কেউ ছাড় পাবে না, প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্বাসের যথাযথ বাস্তবায়ন দেখতে চায় দেশের মানুষ। তাই অনতিবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’

৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষের অনুগত কয়েকজন শিক্ষার্থী। গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা। মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই দিনই গুরুতর আহত অবস্থায় নুসরাতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। শরীরে ৭৫ শতাংশের বেশি পোড়া নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গত ১০ এপ্রিল হার মানেন নুসরাত। এর মধ্যে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ আসামিদের মধ্য ১৭ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্য কয়েকজন এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।

নুসরাতকে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয় ৪ এপ্রিল। কেরোসিন কেনা হয় ৫ এপ্রিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় ৬ এপ্রিল। এদিন পরীক্ষা দিতে এলে কৌশলে মাদ্রাসার তিনতলা ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয় নুসরাতকে। এরপর কেউ পা বাঁধেন ওড়না দিয়ে, কেউ কেরোসিন ঢেলে দেন পা থেকে বুক পর্যন্ত। অন্য একজন দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন গায়ে। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন পাঁচজন আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময় লেগেছে মাত্র পাঁচ মিনিট। সবই করা হয়েছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার নির্দেশে।

এমন লোমহর্ষক বর্ণনা উঠে এসেছে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যার সঙ্গে জড়িত দুই আসামির জবানবন্দিতে। তাঁরা হলেন মামলার অন্যতম প্রধান আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন। গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে ৬ এপ্রিল তাঁর ওপর অগ্নিসন্ত্রাস চালানোর ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তাঁরা। এই হত্যাকাণ্ডের পর খুনিরা বিষয়টি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন এবং পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলমকে জানিয়েছিলেন। এই খুনের ঘটনায় মাকসুদ এখন কারাগারে। হত্যাকাণ্ডের আগে অধ্যক্ষ ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামের ২০ সদস্যের কমিটির জন্য টাকা দিয়েছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা কেফায়েত উল্লাহ।

পুলিশ, আইনজীবী ও আদালত সূত্রে পাওয়া জবানবন্দিতে দেখা যায়, পুরো ঘটনায় ২৫-২৬ জন জড়িত। গত রোববার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে দুই আসামিকে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে রাত প্রায় একটা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দুই আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম ২৫ পৃষ্ঠা এবং নুর উদ্দিন ৩০ পৃষ্ঠার জবানবন্দি দেন।