আফতাই কোথায় গেল?

বাবাকে নিয়ে অফিস থেকে মাকে আনতে গিয়েছিল সাত বছরের আফতাই। ফেরেনি। তিন বছরের আরাফাত বায়না ধরেছিল বাবার সঙ্গে চকবাজারে যাবে। ফেরেনি। মা-বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিল ১০ বছর বয়সী সাহির। ফেরেনি সেও। খুঁজে পাওয়া যায়নি আফতাইয়ের কোনো চিহ্ন। চকবাজারে পুড়ে যাওয়া শিশুদের বেঁচে থাকা স্বজনদের প্রশ্ন, কোথায় হারাল তাঁদের বুকের ধন?

শিশু আফতাই আহম্মেদ, তার বাবা ছালেহ আহম্মেদ ও মা নাছরিন জাহান। ছবি: সংগৃহীত
শিশু আফতাই আহম্মেদ, তার বাবা ছালেহ আহম্মেদ ও মা নাছরিন জাহান। ছবি: সংগৃহীত

চিহ্ন মেলেনি তার
বাইসাইকেলটা ঘরের মধ্যে হেলান দিয়ে রাখা। আফতাই যেভাবে রেখে গিয়েছে, সেভাবেই আছে। ছোট্ট একটা হেলমেট সবুজ রঙের সাইকেলটার ওপর। গত দুই মাস কেউ ব্যবহার করেনি। সাইকেলটা দেখে আফতাইয়ের কথা মনে পড়ে তার বড় চাচা আলী আহম্মেদের। সাইকেলটা ছিল আফতাইয়ের বিকেলবেলার আনন্দ আর ব্যস্ততা।

আফতাইয়ের বাবা ছালেহ আহম্মেদ নিপু ব্যবসায়ী। মা নাছরিন জাহান চাকরি করতেন লালবাগের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তাঁদের বাসা চকবাজারের উর্দু রোডে। আফতাই পড়ত বকশীবাজারের বীকন ইনস্টিটিউটে। সকালে মা অথবা বাবা তাকে স্কুলে দিয়ে যেতেন। স্কুল থেকে ফিরে প্রায়ই চলে যেত বড় চাচা আলী আহম্মেদের বাসায়। গত ২০ ফেব্রুয়ারিতে আগুন লাগার দিন বিকেলেও এসেছিল। ভুল করে ফেলে এসেছিল একটা পানির বোতল। সেটা দেখিয়ে এখনো কাঁদেন আলী আহম্মেদ।

সেদিন (২০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় আফতাইয়ের জেদে ছালেহ আহম্মেদ ছেলেকে নিয়ে ছেলের মা নাছরিনের অফিসে যান তাঁকে আনতে। রাত ১০টার পর রিকশায় উর্দু রোডের বাসায় ফিরছিল এই পরিবার। যথারীতি চকবাজারের চুড়িহাট্টা গলির সামনে তখন যানজট। রিকশা এগোয় না। ভিড়ের মধ্যে রিকশায় বসে তারা কী ভাবছিল, শেষ মুহূর্তে তা জানা যায় না। ঠিক এমন সময়ই আগুনের ঢেউ ঢেকে ফেলল সমগ্র গলি।

আফতাই আহম্মেদ। ছবি: সংগৃহীত
আফতাই আহম্মেদ। ছবি: সংগৃহীত

চুড়িহাট্টার কাছেই ছিলেন আফতাইয়ের আরেক চাচা দীন মোহাম্মদ। আগুন দেখেই তাঁর মনে পড়ল, এই গলি দিয়েই তো আফতাইদের বাসায় ফেরার কথা। সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলেন আফতাইয়ের বাবাকে। তাঁকে না পেয়ে মাকে। নাছরিনের ফোন একবার বেজে উঠে অদ্ভুত শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও বহুবার ফোন দিয়ে গেছেন দীন মোহাম্মদ। না ফোন, না নাছরিন, কেউ সাড়া দেননি।

আফতাইয়ের বাবা আর মায়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তাঁরা যে আফতাইয়েরই মা-বাবা, ফরেনসিক পরীক্ষায় সেই প্রমাণও মিলেছিল। কিন্তু কোনো চিহ্ন মেলেনি আফতাইয়ের, না জীবিত, না মৃত। কী পরিণতি হয়েছিল ছেলেটির? এই প্রশ্ন, এই জিজ্ঞাসা আফতাইয়ের বড় চাচা ব্যবসায়ী আলী আহম্মেদের। রোজ স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর ছেলেটি চলে আসত বড় চাচার (আলী আহম্মেদের) বাসায়। সেখানেই খেলা করত। আলী আহম্মেদকে ডাকত ‘বড় আব্বু’ বলে। সেদিনও এসেছিল, ডেকেছিল ‘বড় আব্বু’ বলে। ভুলে তারা ফেলে যায় বাইসাইকেলের সঙ্গে রাখা পানির বোতলটি। সেটি যত্নে রাখা আছে আলী আহম্মেদের কাছে। কেউ এলে দেখান।

আফতাইয়ের বাবা সালেহ ছিলেন চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে সবার ছোট। আলী আহম্মেদ যখন কথা বলছিলেন, তখন আফতাইয়ের আরেক চাচা দীন মোহাম্মদ ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন, ‘আমাদের আফতাই গেল কোথায়? কোথায় হারিয়ে গেল আফতাইয়ের লাশ। কী হইছিল তার?’

চুড়িহাট্টার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আফতাইদের পুরো পরিবার।

আফতাই আহম্মেদের বড় চাচা আলী আহম্মেদ। ছবি: আসাদুজ্জামান
আফতাই আহম্মেদের বড় চাচা আলী আহম্মেদ। ছবি: আসাদুজ্জামান

বাবার কোলেই মৃত্যু
মা তারামণিকে আর বাবা মান্নানকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায় মোহাম্মদ আলীর। তখন আরাফাত বায়না ধরে বাবার সঙ্গে চকবাজারে যাবে। ছেলেকে কোলে নিয়ে চকবাজারের দোকানে আসেন মোহাম্মদ আলী। সেখানে দেখা হয় চাচা অপু আর দীপুর সঙ্গে। তাঁরাও চকবাজারেরই অন্য দোকানে চাকরি করেন। ছেলেকে বাজার দেখিয়ে ফিরছিলেন বাবা। দীপু আরেকটু আগেই দোকান বন্ধ করে বাসার উদ্দেশে হাঁটা দেন। একটু পেছনে বাবার কোলে আরাফাত আর চাচা অপু। সবাই ফিরছিল বাসায়।

পরিবারটির পুরুষ সদস্যদের আসার পথে পড়ে চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশন। ভবনটির সামনে আসতেই আগুনের গোলা ছুটতে থাকে। আরাফাতকে কোলে করে আলী আর অপু দুজনেই ওয়াহেদ ম্যানশনের গলিতে ঢুকে পড়েন। এদিকে আরাফাতের ছোট চাচা দীপু চুড়িহাট্টার গলি পর্যন্ত পৌঁছেছেন। ওদিকে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে থেকে বিকট শব্দ আসছে। দীপু পেছনে ফিরে দেখেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে দীপু তাঁর ভাইদের ফোন দেন। দুজনেরই রিং বাজে, কিন্তু কেউ ধরেন না। একসময় রিংয়ের আওয়াজও বন্ধ হয়ে যায়।

পরদিন ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের মর্গে মেলে আলী, অপু আর আরাফাতের মরদেহ।

প্রথম আলোকে দীপু বলেন, ‘কারও দেহ পোড়ে নাই। ফায়ার সার্ভিসের লোকদের কাছে শুনেছি, আরাফাত নাকি ছিল বাবা-চাচার বুকের মাঝখানে। পথের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে ছিল তারা।’

নিহত শিশু আরাফাত ও তাঁর বাবা মোহাম্মদ আলী। ছবি: সংগৃহীত
নিহত শিশু আরাফাত ও তাঁর বাবা মোহাম্মদ আলী। ছবি: সংগৃহীত

আরাফাতের মা ইতি আক্তার রোজ ভাবেন, এই বুঝি তাঁর স্বামী আলী আরাফাতকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরল। ডাকল, ‘ইতি, দরজা খোলো।’ আর আরাফাত বাবার কোল থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে মায়ের কোলে। ডাকছে ‘আম্মু’।

অ্যালবামের পাতা ওলটাচ্ছিলেন ইতি আক্তার। পাতায় পাতায় আরাফাত আর আলীর ছবি। ইতির চোখের পানি প্রায় দুই মাস পরেও শুকায়নি। ছবি দেখছিলেন আর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল বিন্দু বিন্দু অশ্রু। একপর্যায়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, ‘বুকের মানিক আরাফাত আমার কই হারাইল?’

ওদিকে আরাফাতের অসুস্থ দাদি বলে চলেন, ‘ও আলী, ও অপু, ও আরাফাত, তোরা কই চইলা গেলি রে।’

ইতি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দেবর অপু রেখে গেছেন সাত মাসের কন্যাশিশু। আলী আর অপুর আয়ে চলত সংসার। আরাফাতের দাদি তারামণি বলেন, ‘এক পরিবার থেকে তিনজন মইরা গেল। দুই মাস পার হয়া গেল। বাসা ভাড়া দিতে পারি না। সরকার মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়া আর খবর লয় না।’

আগুনে মারা গেছে রামীমের (ডানে) মা সোনিয়া, বাবা মিঠু, ছোট ভাই সাহির। ছবি: সংগৃহীত
আগুনে মারা গেছে রামীমের (ডানে) মা সোনিয়া, বাবা মিঠু, ছোট ভাই সাহির। ছবি: সংগৃহীত

বারো বছর বয়সীর নরকদর্শন
রাতে ঘুমের মধ্যেই কেঁদে ওঠে রামীম। জেগে উঠে মাকে খোঁজে, কিন্তু পায় না। বাবাও কোথাও নেই। ছোট ভাইটাকে ডাকে, উত্তর আসে না।

সন্ধ্যাটা ছিল আনন্দের। লালবাগের ডুরি আঙ্গুর লেনের বাসা থেকে ওরা দাওয়াত খেতে গিয়েছিল চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। সেদিন ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল রামীমের এক বন্ধুর কানফোঁড়ানির অনুষ্ঠান। মা, বাবা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে রামীম রিকশায় করে রওনা দেয় রাত ১০টায়। রামীমদের রিকশা তখন চুড়িহাট্টার গলিতে। হঠাৎ রামীম দেখে আগুনের গোলা আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী। রামীম রিকশা থেকে পড়ে যায়। তার ডান পাশের কিছু অংশ পুড়ে যায়। পরে সে দেখে, ছোট্ট ভাই সাহির বাবার কোলে। সে ভেবেছিল, বাবা ও সাহির বোধ হয় বেঁচে আছে। তাই সে বাবা আর সাহিরের দেহে ধাক্কা দেয়। দেখে নড়ে না। কিন্তু মা সোনিয়াকে সে আর কোথাও দেখেনি।

আশপাশের লোকদের ডেকে রামীম বলে, ‘আমার বাবা কথা বলছে না কেন?’ স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে খালার মুঠোফোনে ফোন দিতে পারে সে। খালার মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন মামা রায়হান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রামীমের চোখের সামনে তার মা-বাবা আর ছোট ভাই সাহির আগুনে পুড়ে মারা গেছে।

রামীম বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফ স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তার মামা রায়হান জানালেন, প্রতিষ্ঠানটি মা–বাবাহারা রামীমের পাশে দাঁড়িয়েছে। রামীম এখন থাকে নানির বাসায়। গত মঙ্গলবার লালবাগের বাসায় গিয়ে দেখা গেল, রামীম চুপ হয়ে বসে আছে। রায়হান যখন চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনা বলছিলেন, তখন রামীমের নানি রুকসানা কাঁদছিলেন।

রায়হান বললেন, দুই মাস ধরে রামীম বাসায় থাকে। এখনো রামীমের হাতে আগুনের ক্ষত। বাসায় থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে ওঠে ছেলেটি। মা-বাবা আর ভাইয়ের কথা মনে উঠলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। ১২ বছর বয়স, এই বয়সেই সাক্ষী হয়েছে মা-বাবা ও ছোট ভাইয়ের আগুনে পোড়া মৃত্যুর!

নানির বাসায় শিশু রামীম (ডানে)। ছবি: আসাদুজ্জামান
নানির বাসায় শিশু রামীম (ডানে)। ছবি: আসাদুজ্জামান



আগুনের রহস্য: আজও মেলেনি উত্তর
বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে বলছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে আগুন লেগেছিল, তা আজও জানা যায়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ইব্রাহীম খান গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকে যে আগুনের সূত্রপাত, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু দোতলায় কীভাবে আগুন লেগেছিল, তা জানা যায়নি। তবে ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা ভাড়া নিয়েছিল পার্ল ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

পুলিশ কর্মকর্তা ইব্রাহীম খান আরও বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকে আগুন কীভাবে লাগল, বিষয়টি জানার জন্য পার্ল ইন্টারন্যাশনালের লোকজনকে দরকার। তাঁরা বলতে পারবেন কীভাবে আগুন লেগেছিল।

চুড়িহাট্টার আগুনে ৭১ জন লোক মারা যাওয়ার দুই মাস পার হলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ভীষণ ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন। কেবল ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক হাসান আর সোহেল কারাগারে আছেন। আদালত সূত্র বলছে, সম্প্রতি দুজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ছালেহ আহম্মেদের বড় ভাই আলী আহম্মেদের অভিযোগ, হাসান আর সোহেলের লোভের আগুনে পুড়ে মারা গেছে তাঁর ভাই ছালেহ, ভাইয়ের স্ত্রী নাছরিন, ভাইপো আফতাইসহ ৭১ জন। কিন্তু ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় কেমিক্যালের গোডাউন ভাড়া নেওয়া পার্ল ইন্টারন্যাশনালের কাউকে পুলিশ ধরছে না।

আলী আহম্মেদ জানালেন, পার্ল ইন্টারন্যাশনালের মালিক হলেন কাসেফ নূর। তিনি অবাঙালি এবং প্রভাবশালী।

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া আরাফাতের মা ইতি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাদের লোভের আগুনে আমার সোনার সংসার পুড়ে তছনছ হয়ে গেছে, তাদের যেন সরকার না ছাড়ে। তাদের যেন শাস্তি হয়।’