চুরি শেষে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল চোর!

বৃহস্পতিবার ভোর ছয়টা। রনি অগাস্টিন গোমেজ সাভারের বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন। তাঁর মুঠোফোন তখন বেজে ওঠে। ঘুমের ঘোরে ফোন ধরলেন রনি গোমেজ। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে পরিচিত লোকটি বললেন, ‘রনি দাদা, আপনার ঢাকার বাসায় আগুন লেগেছে। বাসার ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।’

রনি গোমেজ ভাড়া থাকেন পূর্ব রাজাবাজার এলাকায়। ১০ বছর ধরে সেখানকার চারতলা বাসায় স্ত্রী আর এক সন্তানকে নিয়ে বসবাস করে আসছেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি করেন। কাল ইস্টার সানডে। এ উপলক্ষে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে গিয়েছিলেন সাভারে নিজের বাড়িতে।

বাসায় আগুন লাগার খবর পেয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে বাসায় চলে আসেন রনি। দেখেন, বাসায় ঢোকার প্রধান ফটক খোলা। বাসার দুটি জানালার গ্রিল কাটা। বাসার ভেতরের এয়ারকন্ডিশন (এসি) পোড়া। সোফা সেট, টিভি, ওয়ার্ডরোব পুড়ে গেছে। দুটি কক্ষের ফ্যানে পোড়া দাগ। আগুনে পুড়ে গেছে দেয়ালঘড়ি। কক্ষের ভেতরের সাদা রং পুড়ে ছাই রং ধারণ করেছে।

পুড়ে যাওয়া ঘরে রনি অগাস্টিন গোমেজ। ছবি: আসাদুজ্জামান
পুড়ে যাওয়া ঘরে রনি অগাস্টিন গোমেজ। ছবি: আসাদুজ্জামান



রনি গোমেজের বাসায় আজ শনিবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, বাসার ছাদে রাখা পোড়া সব আসবাব। পোড়া টিভি, পোড়া কম্বল। বাসার ভেতরে পোড়া ওয়ার্ডরোব। আগুনে পুড়ে গলে গেছে ইলেকট্রিক তার। রনি গমেজ জানালেন, রান্নাঘরে রাখা ফায়ার বক্স পেয়েছিলেন খাটের ওপরে। বাসা থেকে কয়েক ভরি সোনা আর হাজার বিশেক টাকা তাঁর খোয়া গেছে। কিন্তু তাঁর লেখাপড়ার সনদ এবং জমির দলিলপত্র—কিছুই তিনি পাননি।

সাধারণত চোর চুরি করে পালিয়ে যায়। কিন্তু চুরি করে বাসায় আগুন দেওয়ার ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না রনি গোমেজ। রোজ সকালে অফিসে যান, বাসায় ফেরেন রাতে। রনির দাবি, কারও সঙ্গে তাঁর কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

বাসায় পুড়ে যাওয়া আসবাব। ছবি: আসাদুজ্জামান
বাসায় পুড়ে যাওয়া আসবাব। ছবি: আসাদুজ্জামান

রনির বাসার চুরি ও আগুন দেওয়ার ঘটনাটি তদন্ত করছেন শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বিশ্বজিৎ সূত্রধর। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলে তিনি গেছেন। বাসায় আগুন দেওয়া হয়েছে। কেন এ ঘটনা, তার রহস্য উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করছেন।

রনি গোমেজ যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেই বাড়ির মালিকের নাম কিরণ কস্তা। কিরণের স্ত্রী ফ্লোরেন্স কস্তা নিজ বাসায় প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন ভোরবেলা তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। বাড়ির কাজের লোকের কাছে জানতে পারেন, রনি গোমেজের বাসা থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হচ্ছে। গেলেন সেখানে। দেখেন বাসার ভেতর প্রচণ্ড ধোঁয়ার কুণ্ডলী। বাসায় ঢোকার প্রধান ফটক তালা লাগানো। তখন উপায় না পেয়ে হাতুড়ি দিয়ে তালা ভাঙা হলো। কাজের লোকজন বাসার ভেতর পানি ঢেলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

পোড়া এসি। ছবি: আসাদুজ্জামান
পোড়া এসি। ছবি: আসাদুজ্জামান

বাসায় চুরির পর আগুন দেওয়ার ঘটনায় সেদিনই (১৮ এপ্রিল) বিচার চেয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন রনি গোমেজ।

চারতলা বাসায় ঢোকার প্রধান ফটক একটি। যা সব সময় তালা লাগানো থাকে। বাসায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা নেই। তবে একজন তত্ত্বাবধায়ক এবং একজন নিরাপত্তারক্ষী সার্বক্ষণিক বাসায় অবস্থান করেন। তত্ত্বাবধায়ক হলেন পলাশ আর নিরাপত্তারক্ষী মোস্তাফিজুর রহমান। দুজনে বাসার নিচতলার প্রধান ফটকের পাশের একটি কক্ষে থাকেন।

বাসার তত্ত্বাবধায়ক পলাশ দাবি করলেন, তখন ভোরবেলা। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। পাশের বাসার একজন নিরাপত্তারক্ষী ঘুম থেকে তাঁকে ডেকে ওঠান। বলেন, বাসার চারতলায় আগুন লেগেছে। ঠিক একই কথা বললেন ওই বাসার নিরাপত্তারক্ষী মোস্তাফিজ।

বাসার পেছনে পাওয়া স্যান্ডেল ছবি: আসাদুজ্জামান
বাসার পেছনে পাওয়া স্যান্ডেল ছবি: আসাদুজ্জামান

যে নিরাপত্তারক্ষী আগুন লাগার খবর সবাইকে জানান, তাঁর নাম লুকাস। যে বাসায় চুরি হয়েছে, তার উল্টো পাশের বাসার নিরাপত্তারক্ষী। তিনি জানালেন, ভোরবেলা তিনি গেটে ছিলেন। তখন পাশের বাসার এক লোক এসে তাঁকে জানান, বাসা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তখন তিনি দৌড়ে গিয়ে ওই বাসার নিরাপত্তারক্ষীকে এ ঘটনা জানান।

বাড়িওয়ালা ফ্লোরেন্স কস্তা জানালেন, বাসার পেছনের অংশে এক জোড়া স্যান্ডেল পাওয়া গেছে। চোরেরা বাসার পেছনের পাইপ বেয়ে ওপরে উঠেছে বলে তাঁদের ধারণা। বাসার নিরাপত্তারক্ষী মোস্তাফিজ দেখালেন সেই এক জোড়া স্যান্ডেল। সবুজ রঙের স্যান্ডেল। বাসার তত্ত্বাবধায়ক পলাশ বললেন, ওই স্যান্ডেল জোড়া তিনি দেখেন বাসার পেছনে। পাইপ বেয়ে দুর্বৃত্তরা ওপরে উঠেছে বলে তাঁর বিশ্বাস। বাসার পেছনের অংশে পয়োনিষ্কাশনের চারটি পাইপ রয়েছে।

রনি অগাস্টিন গোমেজের বাসায় আগুন দেওয়ার ঘটনার বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানে আলম মুনশী জানালেন, বাসায় আগুন দিয়ে চুরির ঘটনার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি খোঁজ নিচ্ছেন।

কাটা গ্রিল। ছবি: আসাদুজ্জামান
কাটা গ্রিল। ছবি: আসাদুজ্জামান

রনি গোমেজ বললেন, তিন দিন হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত কোনো দুর্বৃত্তরা ধরা পড়েনি। কেন তাঁর বাসায় আগুন দেওয়া হলো, তা–ও তিনি জানতে পারেননি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার শনিবার টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বাসায় আগুন দিয়ে চুরির ঘটনাটি তাঁর জানা নেই। তবে বাসায় আগুন দেওয়ার ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হবে এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

বাসায় আগুন দেওয়ার পর রনি অগাস্টিন গোমেজ থাকছেন মনিপুরী পাড়ার একটি বাসায়। রনি গোমেজ বললেন, দুর্বৃত্তরা কেন এ ঘটনা ঘটাল, তা তিনি জানতে চান। রনি অগাস্টিন গোমেজ বললেন, ‘আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা চাই। এ ঘটনার বিচার চাই।’