এক সাংসদের শপথ, বিপাকে বিএনপি

>
  • আরও কয়েকজনের শপথের প্রস্তুতি নিয়ে গুঞ্জন
  •  নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ
  • কাল স্থায়ী কমিটির বৈঠক

দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নিয়েছেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে বিএনপির সাংসদ জাহিদুর রহমান। আরও কয়েকজন শপথ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে গুঞ্জন আছে। বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে দলীয় সাংসদের আকস্মিক শপথ নেওয়ার ঘটনায় নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ। এটি দলের নীতিনির্ধারকদেরও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, দলীয় সাংসদদের দলছুট করা এবং সংসদে যোগদান করানোর পেছনে সরকারের হাত রয়েছে। তাঁদের দাবি, এর পেছনে বড় ধরনের লোভ ও টোপ কাজ করেছে। তবে এক সাংসদের শপথ গ্রহণ দলকে বিপদের সম্মুখীন করবে। তাঁর সংসদে যোগদান দলের এত দিনের ঐক্যে চিড় ধরাতে পারে। পাশাপাশি দলের শীর্ষ নেতৃত্বেও অনাস্থা-অবিশ্বাস সৃষ্টি করার আশঙ্কা রয়েছে।

কিছুদিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হতে পারে। এর বিনিময়ে বিএনপি সংসদে যোগ দেবে। কিন্তু এমন কিছু হওয়ার আগেই দলের সাংসদ জাহিদুর রহমান শপথ নিলেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে তাঁকে শপথ পড়ান।

এ খবর জেনে বিব্রত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বাসা থেকে বের হননি। রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত আছে সংসদে না যাওয়ার। আমরা সেখানেই আছি। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। যিনি সংসদে যোগ দিয়েছেন, তিনি দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গতকাল শপথ নেওয়ার পর জাহিদুর রহমান সংসদের অধিবেশনে যোগ দেননি। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মহাসচিব বাদে দলের বাকি সদস্যরাও শপথ নিতে পারেন। দেখি তাঁরা আসেন কি না। এলে একসঙ্গে সংসদে যোগ দেব।’

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য, বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জন সাংসদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন শিগগিরই সংসদে যোগ দিতে পারেন। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের মো. আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মো. হারুনুর রশীদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার ও বগুড়া-৪ আসনের মো. মোশাররফ হোসেনের নাম আলোচনায় আছে। তাঁদের অনেকে সরকারের মহলবিশেষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে জানা গেছে।

সংসদে যোগদানের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ হারুনুর রশীদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’

আর উকিল আবদুস সাত্তার বলেন, তাঁর যোগদান ‘এখনো নিশ্চিত নয়’। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা বিপদের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের থেকে সংসদে যাওয়ার চাপ আছে।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তারা ভোট ডাকাতির এই সংসদে যাবে না। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের রাতেই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি।  বিএনপি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাংসদ জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। আগামীকাল শনিবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হবে।

সরকারি ও বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত এই চার দিনে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার প্যারোলে অথবা জামিনে মুক্তি পাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিএনপির কোনো কোনো সাংসদ এমন কিছুর অপেক্ষায় আছেন বলে জানা গেছে। যাতে দলীয় প্রধানের মুক্তির পর তাঁদের সংসদে যোগদান করাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উকিল আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ জন্যই তো দেরি হইতেছে।’

সংবিধানে বলা আছে, সংসদের প্রথম বৈঠকের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে সদস্যপদ বাতিল করে আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে। একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক বসে গত ৩০ জানুয়ারি। এই হিসাবে ২৯ এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিতে হবে।

এই ক্ষণগণনা থেকেই সম্প্রতি সমঝোতার মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি এবং বিএনপির সংসদে যোগদানের বিষয়টি আলোচনায় আসে। সরকারি দলের একাধিক নেতা ও মন্ত্রী বিএনপিকে সংসদে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। যদিও বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়ার প্যারোল এবং এর বিনিময়ে সংসদে যোগদানের গুঞ্জনকে নাকচ করে দিয়েছেন।

সাংসদ জাহিদুরের শপথ নেওয়ার খবর জানাজানি হওয়ার পর বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। সেখানে অনেককে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তাঁদের বক্তব্য, এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে কিছুদিন ধরে একরকম জানাজানি ছিল। কিন্তু দলের কোনো পর্যায় থেকে তা ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বরং দলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের কাউকে কাউকে সংসদে যোগদানের ব্যাপারে নমনীয় দেখা গেছে।

খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া বিএনপির সংসদে না যাওয়ার ব্যাপারে কট্টর অবস্থান স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের। তিনি গতকাল বলেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যাঁরা সংসদে শপথ নিয়েছেন বা নেবেন, তাঁরা ‘গণদুশমন’। দলের সিদ্ধান্ত যিনি অমান্য করবেন, তিনি দলের ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন না। এই সহজ কথাটা আপনারা বুঝে নিন।’

অবশ্য জাহিদুর রহমান বলেছেন, ‘এমনিতে আমার আর নির্বাচন করার ইচ্ছা নেই। আমি ক্লান্ত। ১৯৯১ সাল থেকেই তো নির্বাচন করে যাচ্ছি। দল বহিষ্কার করে করুক। আমি তো আর দলকে ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি দলের সঙ্গেই থাকব।’

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করা এবং সংসদে যোগদানের বিষয়ে দলের ভেতর থেকে একটা প্রচেষ্টা আছে। যার সঙ্গে সরকারি মহলের যোগসাজশ রয়েছে, যেটি অনেকটা অদৃশ্যমান। এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মতবিরোধ রয়েছে। স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের পরও সংসদে যোগদানের ঘটনায় নেতাদের অনেকেই অবাক হয়েছেন। অনেকে বলেছেন, এতে দলের ওপর শীর্ষ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে।

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যেসব সাংসদ শপথ গ্রহণ করেছেন, আইন অনুযায়ী তাঁদের সদস্যপদ থাকবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তবে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান ও জাহিদুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করেননি। সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগও নেই তাঁদের। তবে তাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিলে এবং ওই অবস্থায় দল তাঁদের বহিষ্কার করলে পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা আছে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে হলে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থাকতে হবে।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে জয়ী দুই সাংসদ আলাউদ্দিন ও হাসিবুর রহমান আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে উপমন্ত্রী হয়েছিলেন। সে সময়ে বিএনপি তাঁদের বিরুদ্ধে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের অভিযোগ করলে দুজনের সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়ে যায়। আলাউদ্দিন রাজশাহী আর হাসিবুর রহমান সিরাজগঞ্জের সাংসদ ছিলেন। পরে আলাউদ্দিনের আসনে উপনির্বাচন হয়। আর হাসিবুর রহমান তাঁর সদস্যপদ খারিজের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। মামলা চলাকালে সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের সুবিধাভোগী নেতা বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। রাজনীতিতে এঁদের আসা-যাওয়া থাকবে। তাই আরও কতজন সংসদে গেল, এটা ইস্যু নয়, এতে বিএনপিরও কিছু যায়-আসে না। কারণ দেশের মানুষ, বিশ্ব সম্প্রদায় এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং সংসদে কারও যোগদান বিষয়ে মানুষের যে চিন্তা, তার কোনো পরিবর্তন হবে না।’

এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ধারণা, দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে শপথ নেওয়ার ফলে জাহিদুর রহমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছেন মর্মে বেশ কয়েকটি যুক্তি দাঁড় করানো যাবে। ৭০ অনুচ্ছেদের মমার্থ হলো, একটা দল থেকে নির্বাচিত হয়ে সেই দলের বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেলে সদস্যপদ বাতিল হবে। ফলে জাহিদ ৭০ অনুচ্ছেদের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী কাজ করেছেন। এই বিবেচনায় জাহিদ সংসদ সদস্য পদে থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েছেন।’