রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি স্বজনদের

>
  • নারায়ণগঞ্জে সাত খুন
  • স্বজনের এখন একটাই দাবি, খুনিদের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক
  • তাঁরা সরকারের কাছে সহায়তা চেয়েছেন

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের ৫ বছর পূর্ণ হলো আজ ২৭ এপ্রিল। নিহত ব্যক্তিদের সবার স্বজনের এখন একটাই দাবি, খুনিদের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক। এদিকে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারানোয় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের কয়েকজনের দিন কাটছে অভাব–অনটনে। তাঁরা সরকারের কাছে সহায়তার দাবি করেছেন।

নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় নিম্ন আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং অপর ৯ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। হাইকোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। গত মাসে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মূল আসামিরা আপিল করেন। ওই তিন সাবেক কর্মকর্তা ও নূর হোসেনসহ প্রধান আসামিরা কারাগারে রয়েছেন।

গত বুধবার বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী মধ্যপাড়া এলাকায় নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়িচালক নিহত জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে কথা হয় তাঁর স্ত্রী সামসুন নাহারের সঙ্গে। সামসুন নাহার বলেন, ৫ বছর হয়ে গেল এখনো খুনিদের বিচার কার্যকর করা হলো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই খুনিদের ফাঁসি দেওয়া হোক। তিনি আরও বলেন, ‘আর্থিক অনটনে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ৬ হাজার টাকা বেতনে সিটি করপোরেশনে যে চাকরি করি তা দিয়ে সংসার চলে না। আমার চাকরিটা স্থায়ী করার দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে রওজার বয়স সাড়ে ৫ বছর। ও সারাক্ষণ ‘আব্বু আব্বু’ বলে ডাকে। ওর বাবার ছবি ধরে কান্নাকাটি করে। আমি কষ্ট করেছি, কিন্তু আমি আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চাই না। সরকার যেন নিহত ব্যক্তিদের দরিদ্র পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়।’

প্রায় একই অবস্থা নিহত নজরুল ইসলামের সহযোগী তাজুল ইসলাম, বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের পরিবারের। তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ভাই রিপন বলেন, আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক। দেশবাসী দেখুক, অপরাধ করলে আইনের লোকও ছাড়া পায় না। বিচার হয়।

নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, ‘খুনিরা শুধু আমার ছেলেকেই হত্যা করেনি। পুরো একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় আছি।’ প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ নিহত সাতজনের রুহের মাগফিরাত কামনায় আজ দিনব্যাপী কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া এতিমদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হবে।

মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই, হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তা আপিল বিভাগেও বহাল থাকুক এবং দ্রুত খুনিদের রায় কার্যকর করা হোক। আমার পরিবারসহ সাতটি পরিবার ধ্বংস হয়েছে। আমরা চাই না আর কারও সংসার এভাবে ধ্বংস হয়ে যাক। এ কারণে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।’ তিনি বলেন, ‘এ রায় নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। আমরা সবাই আশা নিয়ে বসে আছি সাত খুন হত্যার বিচার হবে। হত্যাকারীদের বিচার এই বাংলার মাটিতে, সারা দেশবাসী দেখুক।’ তিনি দ্রুত রায় কার্যকরে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।

সাত খুন মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সাত খুন মামলার রায় সারা দেশের মানুষ কার্যকর দেখতে চায়।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জের আদালতে একটি মারামারির মামলায় হাজিরা দিয়ে ঢাকার বাসায় ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, নজরুলের সহযোগী ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের কর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন, জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম ও স্বপনের প্রাইভেট কারের চালক জাহাঙ্গীরকে প্রথমে অপহরণ করা হয়। পরে এ ঘটনা দেখে ফেলায় নারায়ণগঞ্জ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়ির চালক ইব্রাহিমকে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন। মামলার তদন্তকারী সংস্থা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ এক বছর তদন্ত শেষে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এম এম রানা ও নূর হোসেনসহ ৩৫ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাত খুন মামলার রায়ে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন, কমান্ডার এম এম রানা ও সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হাইকোট৴ ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক ৩ কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন এবং অপর ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখা হয়। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। এরপর গত ৩ মার্চ আসামিরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।