ধানে চিটা নিয়ে দিশেহারা কৃষক

ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাবে চিটা হয়ে যাওয়া ধান দেখাচ্ছেন এক কৃষক। গতকাল রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুর্গাপুরের পারিশো গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাবে চিটা হয়ে যাওয়া ধান দেখাচ্ছেন এক কৃষক। গতকাল রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুর্গাপুরের পারিশো গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

তানোরের পারিশো গ্রামের চাষি সেলিম রেজা। ৬৫ বিঘা জমিতে তিনি ধান লাগিয়েছেন, যার ৮ বিঘা জমির ধান চিটা হয়ে গেছে, গাছের অর্ধেক শুকিয়ে খড় হয়ে গেছে। অন্যান্য খেতও কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। দিশেহারা এই কৃষক এখন ধান কাটার শ্রমিক পাচ্ছেন না।

তানোরের পারিশো ও মিরাপুর মাঠের চাষিদের ধানখেতের এই অবস্থা হয়েছে। কৃষিবিদেরা বলছেন, বৃষ্টি-ঝড়ের আবহাওয়া ব্লাস্ট রোগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এবার চৈত্র মাসজুড়েই এ রকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ছিল। সে কারণেই তানোরের কিছু জমিতে ‘ব্লাস্ট’ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবারের বোরো মৌসুমে তানোরে প্রায় ৮ হাজার ২৫৫ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে বড় অংশই জিরা, ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধান। ব্লাস্টে বেশি আক্রান্ত হয়েছে জিরা ও ব্রি-২৮ ধান। ঝড়-বৃষ্টির পরের দিনই পুঠিয়ার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের একটি মাঠে এই রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়।

গতকাল তানোরের পারিশো ও মিরাপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের কোনো কোনো খেতের ধানের শিষ একেবারেই মরে গেছে। ধান চিটা হয়ে গেছে। গাছের ওপরের দিকটা মরে খড়ের মতো হয়ে গেছে। তবে নিচের দিকটা এখনো তাজা রয়েছে। আবার কোনো কোনো খেতে অল্প পরিমাণে এই রোগ ছড়িয়েছে। চাষিরা এখন এই ধান কাটার কোনো শ্রমিক পাচ্ছেন না।

কৃষকেরা বলছেন, ১৯ এপ্রিল কৃষি অফিসের লোকজন গ্রামে এসেছিলেন। তাঁরা জুমার নামাজের পরে মসজিদের মাইক থেকে এলাকার চাষিদের পরামর্শ দিয়েছেন। তত দিনে ধানের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। একপর্যায়ে তাঁরাই এসে বলেছেন, আর ওষুধ দিয়ে কোনো কাজ হবে না। তখন তাঁরা ওষুধ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বারবার ওষুধ দিতে গিয়ে বিঘাপ্রতি তাঁদের ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

পারিশো গ্রামের আনসার আলীর তিন বিঘা জমির ধান পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। একই গ্রামের চাষি নজরুল ইসলাম ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন। কিন্তু শেষ সময়ে এসে দেখা যায় ধানের শিষ মরে সাদা হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা দুই–তিন রকম ওষুধ দিয়েছেন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এখন ধানের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

মিরাপুর গ্রামে এমরান আলী সাড়ে তিন বিঘা জমিতে বোরো ধান করেছেন। তাঁর সবটাই নষ্ট হয়ে গেছে। একই গ্রামের আমজাদ হোসেনের দুই বিঘা জমির ধান পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। মোকলেসুর রহমানের তিন বিঘা জমির পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

তানোরের দুর্গাপুর বাজারে পাঁচ-ছয়জন চাষি বলেন, তাঁদের ধানখেতে মহামারি লেগেছে। তাঁদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। পরে জানা গেল, এই চাষিদের জমিও মিরাপুর ও পারিশো মাঠে রয়েছে। তাঁরা বলেন, কৃষি অফিসের লোকেরা উপজেলার কামারগাঁ বাজারের একটি সারের দোকানে এসে বসে থাকেন। সেখানেই কৃষকদের ডেকে কথা বলে চলে যান। মাঠে কমই যান। তাঁরা বলেন, শুধু ব্লাস্ট নয়, তাঁদের জমিতে মাজরা পোকাও লেগেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি ও ঝড়ে ব্লাস্ট রোগ ছড়ানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ। এবারের আবহাওয়াটা সে রকমই ছিল। এ জন্য সারা দেশেই কমবেশি ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ জন্য ছত্রাকনাশক ছিটানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। যেসব চাষিরা তাঁদের পরামর্শ মেনে ছিটাননি, তাঁদের খেতে এই রোগ দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, তাঁরা আবহাওয়ার গতি–প্রকৃতি বুঝে প্রতি সপ্তাহে চাষিদের ‘আপডেট’ দিয়েছেন। গ্রামে গ্রামে সমাবেশ করেছেন। মসজিদের মাইকে বলেছেন। প্রতিদিন বিকেল পাঁচটার পরে সমাবেশ করেছেন। ছত্রাকনাশক ছিটালে এটা হতো না। এতে এক বিঘায় খরচ হয় মাত্র ১০০ টাকা। তাঁদের হিসাবমতে, প্রায় ২০ বিঘা জমির ধানে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। মাঠের অন্য ধানখেত ভালো রয়েছে।