স্বজনদের খোঁজে অপেক্ষা ও কান্না

নিখোঁজ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শেখ মোয়াজ্জেমের ছবি নিয়ে এসেছেন তাঁর মা ছালেহা খাতুন (সামনের সারিতে বাঁয়ে)। পেছনে আরও অনেক নিখোঁজের স্বজনেরা। গতকাল প্রেসক্লাবে, গুম ও গণতন্ত্রের অব্যাহত সংকট নিয়ে আলোচনায়।  ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
নিখোঁজ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শেখ মোয়াজ্জেমের ছবি নিয়ে এসেছেন তাঁর মা ছালেহা খাতুন (সামনের সারিতে বাঁয়ে)। পেছনে আরও অনেক নিখোঁজের স্বজনেরা। গতকাল প্রেসক্লাবে, গুম ও গণতন্ত্রের অব্যাহত সংকট নিয়ে আলোচনায়। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

লিখিত বক্তব্য পড়তে গিয়ে কান্নায় থেমে যায় বৃদ্ধা ছালেহা খাতুনের কণ্ঠ। বক্তব্য শেষেও মঞ্চের অতিথিদের কাছে কেঁদে কেঁদে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাতে থাকেন। তাঁর কান্না ছড়িয়ে পড়ে পুরো হলরুমে বসে থাকা স্বজনহারাদের মধ্যে।

ছালেহা খাতুনের ছেলে শেখ মোয়াজ্জেম হোসেন ২০১১ সালে নিখোঁজ হন। রাজধানীর রামপুরা শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেমকে বাড্ডার একটি বাসা থেকে তুলে নেয় সাদাপোশাকের তিন অস্ত্রধারী। ছেলের দুঃখে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা গেছেন। স্বামী হারিয়ে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আসায় আট বছর ধরে নানা জায়গায় ঘুরছেন তিনি।

শুধু ছালেহা খাতুন নন, স্বজন হারানো ১১টি পরিবারের সদস্যদের এমন আকুতিতে ভারী হয়ে উঠে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তন। গতকাল শনিবার সকালে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘গুম এবং গণতন্ত্রের অব্যাহত সংকট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে নিজেদের দুর্দশার বর্ণনা দেন তাঁরা। পুলিশ প্রশাসন নিখোঁজ বললেও পরিবারের সদস্যরা তা মানতে পারছেন না। তাঁদের দাবি, গুম করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে গুম হয়ে গেছেন তাঁদের প্রিয়জন। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও থামছে না তাঁদের কান্না, মিলছে না স্বজনের হদিস।

আর কাঁদতে চান না মারুফা

আর কাঁদতে চাই না বলে শুরু করলেও কান্না আটকাতে পারেননি মারুফা ইসলাম। ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ তাঁর ভাই সাজেদুল ইসলাম। মারুফা বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৩০ বার দাঁড়িয়েছি এখানে। থানা থেকে শুরু করে প্রশাসনের অনেক জায়গায় গিয়েছি। আর কাঁদতে চাই না। তবে দিন গুনতে গুনতে ঘরে বসে যাব ভাবলে তা ভুল হবে। ভাইকে ফেরত পেতে লড়াই চালিয়ে যাব।’

একমাত্র ছেলের সন্ধানে মায়ের আর্তনাদ

একমাত্র ছেলে সাইদের সন্ধানে যশোর থেকে এসেছেন তাঁর মা হিরা খাতুন। ২০১৭ সালে বন্ধু শাওনের সঙ্গে যশোর শহরের পৌর পার্কে বেড়াতে গেলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাঁদের দুজনকে। কান্নায় বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়ার আগে বলেন, ‘ওর বাবা বেঁচে নেই। আমার একমাত্র ছেলেকে ফিরিয়ে দিন।’

নিখোঁজের পরিবারে পুলিশের হয়রানি

স্বামী ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে নেমে উল্টো পুলিশের হয়রানিতে দিন কাটাচ্ছেন ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ পল্লবীর যুবদল নেতা নুর আলমের স্ত্রী রিনা আলম। এ হয়রানি থেকে মুক্তি চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি অভিযোগ করেন, তিন ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। দুই ছেলেকে পুলিশ ধরে নেওয়ার পর টাকা দিয়ে ছাড়ানো হয়েছে। পুলিশ ধরে নেওয়ার হুমকি দেয়, টাকা চায়। তাই পালিয়ে থাকতে হয়।

কান্নায় বাক্‌রুদ্ধ মাইকেল চাকমার বোন

নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ৯ এপ্রিল নিখোঁজ হন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) অন্যতম সংগঠক ও মুখপাত্র এবং শ্রমজীবী ফ্রন্টের (ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা। খাগড়াছড়ি থেকে এসেছেন তাঁর বোন সুভদ্রা চাকমা। চাকমা ভাষায় ভাইকে ফিরে পেতে সবার সহযোগিতা চান তিনি। পাশ থেকে একজন তাঁর বক্তব্য বাংলা করে দেন। কান্নায় কণ্ঠ রোধ হয়ে আসার আগে বাংলায় শুধু বলেন, বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে।

স্বজনহারাদের সংগঠন

স্বজনের খোঁজে নেমে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গড়ে উঠেছে সংগঠন মায়ের ডাক। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে আফরোজা ইসলাম আলোচনা সভায় বলেন, ‘ভাই সুমনের খোঁজে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াতে গিয়ে আমাদের মতো আরও অনেক পরিবারের খোঁজ মেলে। এসব পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কষ্ট ভাগাভাগি করতে ও প্রতিবাদ চালিয়ে যেতেই গড়ে ওঠে মায়ের ডাক।’

গুম-খুনের বিচার একদিন হবেই

আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক আইনজীবী বলেন, ক্রসফায়ার ও গুমের বিচারও একদিন হবেই। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সময়টা হয়তো এখন বলা যাচ্ছে না। তবে বিচার একদিন হবেই, এটা নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অনেক পরে হলেও এমন অপরাধে বিভিন্ন দেশে বিচার হয়েছে।

আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, স্বজন হারানোর ভয়ে গুমের শিকার পরিবারগুলোর অধিকাংশ সদস্য কোনো মামলা করতে যাননি। এ ঝুঁকি থাকা মানে হচ্ছে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার না থাকা। অথচ সংবিধান অনুযায়ী সবার প্রতিকার পাওয়ার অধিকার আছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গুম হওয়ার পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বা টালবাহানা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, এগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা করছেন। দেশে তো এখন নির্বাচন গুম করে ফেলা হচ্ছে। তবে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ বলেন, অনুভূতি কখনো মরে না। তাই স্বজনদের ফেরার অপেক্ষাও কখনো শেষ হয় না।

আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন শিরীন হক এবং সংগঠনের পক্ষে অবস্থানপত্র পাঠ করেন রেজাউর রহমান। ‘জোরপূর্বক গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব৵ক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ-২০০৬’ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয় অবস্থানপত্রে।