মে দিবস মানে তাঁদের কাছে মেলা

পাথর ভাঙছেন শ্রমিক শফিকুল ইসলাম (বামে)। ছবি: তাফসিলুল আজিজ
পাথর ভাঙছেন শ্রমিক শফিকুল ইসলাম (বামে)। ছবি: তাফসিলুল আজিজ

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। কিন্তু এ দিবসের অর্থ সবার কাছে সমান নয়। ৬০ বছর বয়সী পাথরভাঙা শ্রমিক শফিকুল ইসলামের কাছে মে দিবস মানে মেলা!

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হুনছি মে দিবসে মেলা বসে। এই সব জেনে আমাদের লাভ অইব কী? সব দিনই আমরার লাগি সমান।’ গত সোমবার দুপুরে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে চামড়াবন্দর ঘাটে তপ্ত রোদে ভারী এক হাতুড়ি দিয়ে বড় বড় পাথরে আঘাত করতে করতে এসব কথা বলেন শফিকুল ইসলাম।

শ্রমিকেরা বাস্তবে তাঁদের কতটুকু অধিকার পান? বেশির ভাগ শ্রমিক জানেন না মে দিবস কী? এদিন গণমাধ্যমে কেন তাঁদের নিয়ে আলোচনা হয়? রাস্তায় কেন তাঁদের নিয়ে মিছিল বের হয়? জানার সময় কোথায়? প্রতিদিনের মতো এদিনও তাঁরা নেমে পড়েন রাস্তায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিবার ও সন্তানদের জন্য দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তাঁরা।

শফিকুল ইসলামের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দা। থাকেন করিমগঞ্জের চামড়াবন্দরে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে চামড়াবন্দর ঘাটে পাথর আসে। দীর্ঘ ১০ থেকে ১২ বছর ধরে তিনি পাথরভাঙা শ্রমিকের কাজ করে তাঁর সাত সদস্যের সংসারের খরচ জোগান। ৬০ বছর বয়সে অনেক ভারী হাতুড়ি চালিয়ে বড় পাথর ভাঙতে ভাঙতে তাঁর হাতের তালু দুটি শক্ত হয়ে গেছে।

পরিবার ও সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও তিনি এক দিনের জন্যও বসে থাকেন না। পাথর ভেঙে তাঁর প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। এ দিয়েই তাঁর সংসার চলে। দীর্ঘ কর্মজীবনে কোনো দিনও তিনি মে দিবসে বসে থাকেননি। এমনকি কবে কোনো দিক দিয়ে এ দিবস যায়, সেটাও খোঁজখবর রাখেন না। রাখলেই কী? এদিন যদি তিনি বসে থাকেন, তাহলে খাবার জুটবে না। সে জন্যই তাঁর ধারণা, মে দিবসে মেলা বসে। কিন্তু তাঁর তো মুখে দুমুঠো খাবার জোগানের বাইরে বাড়তি টাকাপয়সা নেই যে মেলার খবর রাখবেন। সে জন্যই তাঁর মে দিবস নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।

একই কথা বললেন শফিকুলের সঙ্গে পাথভাঙা আরেক শ্রমিক নিত্যচন্দ্র সরকার। নিত্যচন্দ্র বলেন, ‘ভাত জোগানের চিন্তায় সব সময় অস্তির থাকি। মে দিবস কী, বলতে পারি না। আর বলেই–বা লাভ কী? শ্রমিকদের খোঁজখবর কে রাখে? দিন দিন বাজারের জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে কি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে? সে জন্য সারা দিন ঘাম ঝরিয়ে কঠোর পরিশ্রম শেষে পরের দিনের রোজগারের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। কোন দিক দিয়ে রাত শেষ হয়ে যায়, তাও টের পাই না।’

এ সময় তাঁদের সঙ্গে ফারুক মিয়াসহ আরও ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক পাথর ওঠানো–নামানোর কাজ করছিলেন। তাঁরাও মে দিবস নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন। এমনকি দিবসটি নিয়ে তাঁদের কোনো আগ্রহ লক্ষ করা যায়নি।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, শ্রমিকেরা এখনো ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। তাঁরা কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতা ছাড়াও মালিকদের শোষণ থেকে এখনো মুক্ত হতে পারছেন না। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের বিধান থাকলেও তাঁদের বাড়তি কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় কাজ করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশের স্বাধীনতার অঙ্গীকার শোষণমুক্ত সমাজ কখনো গড়ে উঠবে না।