ছেলের সব অপকর্মের কথা খুলে বললেন মা

>

• সুফিয়ার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায়
• ছেলের অপকর্মের কথা পুলিশকে বলেছেন মা
• মা স্বেচ্ছায় ছেলের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিয়েছেন

সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা যেমন নিখাদ, তেমনি পক্ষপাতও চিরন্তন। কিন্তু ছেলে অবৈধ আয় করে ধনী হবে, এটা কখনো মেনে নিতে পারেননি সুফিয়া বেগম। যখনই জানলেন ছেলে মাদক ব্যবসায় জড়িয়েছে, তখনই বাধা দিয়েছেন। অবৈধ টাকায় সংসারে সচ্ছলতা আসুক, তা চাননি বলে বাধ্য হয়ে ছেলের সঙ্গে সাময়িকভাবে সম্পর্কও ছিন্ন করেছেন। এতেও কাজ না হওয়ায় স্বেচ্ছায় আদালতে জবানবন্দি দিয়ে ছেলের সব অপকর্মের কথা খুলে বলেছেন তিনি।

সুফিয়া বেগমের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার অজগ্রামে। ৩০ বছর আগে স্বামী হারানোর পর সংসারের হাল ধরতে হয় তাঁকে। তখন ছেলে নবী হোসেন পড়ত পঞ্চম শ্রেণিতে। সংসারের খরচ কুলাতে না পেরে ছেলেকে হকারিতে নামান। কিন্তু ১০–১২ বছর আগে ছেলের আয় স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তে থাকে। প্রথমে বিষয়টি ধরতে পারেননি মা। ছেলে মাদক বেচে ভাগ্য ফেরাবে, তা কল্পনাতেও ছিল না তাঁর।

ট্রেনে বাদাম বিক্রি করা নবী হোসেনের এখন ৪০ লাখ টাকা দামের মাছ ধরার নৌকা (ট্রলার) রয়েছে। ট্রলারটি ভাড়ায় খাটানো হচ্ছে। এলাকায় বিরাট পোলট্রি খামারও দিয়েছেন। কয়েক লাখ টাকা দিয়ে জায়গাজমি কিনেছেন। বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় দানখয়রাত করেছেন। ভাঙা ঘর ভেঙে চকচকে পাকা বাড়ি করেছেন। এসব তথ্য পুলিশকে তদন্ত করে বের করতে হয়নি। নবীর মা সুফিয়া বেগমই পুলিশকে সব জানিয়েছেন। পরে আদালতে জবানবন্দিতেও একই কথা বলেছেন। ছেলের অপকর্ম সম্পর্কে পুলিশকে তিনি বলেন, ‘আমি বাধা দিয়েছি, একবার রাগ করে ছেলেকে ছেড়ে বাপের বাড়ি গিয়ে থেকেছি, তারপরও সে ব্যবসা বন্ধ করেনি।’

যেভাবে ঘটনার শুরু
২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল ২০ লাখ ইয়াবাসহ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকা থেকে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, ইয়াবার চালানটির মালিক চট্টগ্রাম শহরের রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী মোজাহার মিয়া। এ নিয়ে থানায় মামলার পর সিআইডি (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) মোজাহারের অর্থের সন্ধানে নামে। তাঁর ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠানো সাতজনের তথ্য পাওয়া যায়। যাঁরা ইয়াবা কেনার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মোজাহারের ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠাতেন। তাঁদেরই একজন সুফিয়া বেগমের ছেলে নবী হোসেন। ভৈরব থেকে মোজাহারের ব্যাংক হিসেবে প্রায় নিয়মিতই লাখ লাখ টাকা জমা করতেন নবী। সবই ছিল ইয়াবা কেনাবেচার অর্থ।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিন আল আজাদ প্রথম আলোকে জানান, মোজাহারের ব্যাংক হিসাবে ৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন তাঁরা। মোজাহার গ্রেপ্তারের পর এখন কারাগারে। তবে তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে নানা তৎপরতা চলছে।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, মোজাহারের ব্যাংক হিসাবে নবী কেন টাকা পাঠাতেন, সে সম্পর্কে জানতে তাঁকে ডাকা হয়। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সৌদি আরবে চলে যান তিনি। কিছুদিন আগে পুলিশ ভৈরবে তাঁর বাড়িতে যায়। তখন সুফিয়া বেগম ছেলের মাদক ব্যবসার কাহিনি পুলিশকে খুলে বলেন।

সিআইডির বিশেষ সুপার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সুফিয়া বেগম নিজ থেকে ছেলের অপকর্মের কথা আদালতে তুলে ধরতে সহযোগিতা চান। এরপর পুলিশ তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। গত ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম শফি উদ্দিনের কাছে জবানবন্দি নেন।

পুলিশ জানায়, সুফিয়া বেগমের জবানবন্দি রেকর্ড (গ্রহণ) করার পর ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর কাছে জানতে চান, আপনি কি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিলেন, না পুলিশ ভয় দেখিয়েছে? তখন তিনি বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় এসব কথা বলেছি।’

সুফিয়া বেগমের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। পুলিশকে তিনি বলেন, ছেলেটা ট্রেনে বাদাম, চানাচুর ও আইসক্রিম বিক্রি করত। ট্রেনে হকারি করার কাজে কখনো সিলেট, আবার কখনো চট্টগ্রাম চলে যেত। প্রতিদিন ট্রেনে আসা-যাওয়া করতে করতে অনেকের সঙ্গে নবীর পরিচয় হয়ে যায়। এভাবেই একদিন ইয়াবা ব্যবসায়ী মোজাহারের এক ঘনিষ্ঠ লোকের সঙ্গে দেখা হয়। ওই লোক তাকে মোজাহারের কাছে নিয়ে যায়। হকারির বদলে নবী শুরু করে ‘ইয়াবা কেনাবেচা’। এভাবেই হকার ছেলে ধনী হয়ে যায়।

সুফিয়া বেগমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকে যখন বলে, আমার ছেলে মাদক ব্যবসা করে। আর সহ্য করতে পারি না। আমি গরিব হতে পারি, তাই বলে ছেলে বড়ি বেচবে, তা মানব না বাবা।’