উপাচার্যের মেয়াদের শেষ সময়ে কর্মচারী নিয়োগের হিড়িক

>

• উপাচার্যের মেয়াদের শেষ সময়ে ২৩ জনকে নিয়োগ
• ডিসেম্বরে স্থায়ী–অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ ১৩৪ জনকে
• আরও নিয়োগ হতে পারে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মেয়াদের শেষ দিকে এসে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে (মাস্টাররোল) একের পর এক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। গত মার্চ ও এপ্রিলেই ২৩ জনকে নিয়োগ দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা উপেক্ষা করে অস্থায়ী ভিত্তিতে এই নিয়োগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অস্থায়ী (অ্যাডহক) ও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ বন্ধ রাখতে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্দেশনা জারি করেছিল ইউজিসি।

আগামী জুনে উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হবে। এর আগে আরও নিয়োগ হতে পারে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা আছে।

নিয়োগ বন্ধ রাখার বিষয়ে ইউজিসির নির্দেশনা থাকার পরও কিসের ভিত্তিতে এসব কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা জানেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য শিরীণ আখতারও। তবে সব প্রক্রিয়া মেনে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেছেন উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ইউজিসির দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থায়ী ও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োজিত রয়েছে। তাই পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এ ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১৯তম সিন্ডিকেট সভায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৩৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে ওই সভায় নিয়োগ চূড়ান্ত করা হলেও নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামই উপস্থাপন করা হয়নি।

বিপুলসংখ্যক লোক নিয়োগের দুই মাস পর আবারও কর্মচারী নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদে দায়িত্বে থাকা জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা। দুই জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে এমনিতেই অতিরিক্ত জনবল। সেখানে কী এমন দরকার পড়েছে যে অল্প সময়ের ব্যবধানে ৭০-৮০ জন লোক নিতে হবে? এতে ভবিষ্যতে তাঁদের বেতন-ভাতা পরিশোধ ও স্থায়ী করা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হবে। তাঁরা বলেন, এখানে কোনো নিয়োগ-বাণিজ্য হয়েছে কি না, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির তদন্ত করা উচিত।

এর আগে বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদের প্রথম তিন বছরে অস্থায়ী ও দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে ৯৯ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ২ হাজার ৮২৩ জন। তাঁদের মধ্যে কর্মচারীর সংখ্যা ১ হাজার ৫৭০ জন।

সাম্প্রতিক নিয়োগসংক্রান্ত অফিস আদেশগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, উচ্চমান সহকারী, অফিস পিয়ন, পেশ ইমাম, মুয়াজ্জিন, ঝাড়ুদার, সহকারী বাবুর্চি, এমএলএসএস, টেবিল বয় পদে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির এসব পদে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে একজন শ্রমিক তৃতীয় শ্রেণির, আর বাকি ২২ জনই চতুর্থ শ্রেণির। বেতন ধরা হয়েছে দৈনিক সর্বনিম্ন ২৩০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকা।

এ প্রসঙ্গে সহ-উপাচার্য শিরীণ আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা জানা নেই। কারণ, উপাচার্য এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি।’

অবশ্য উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজনের ভিত্তিতে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ দেওয়ার জন্য বোর্ড ছিল। সততার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছে বোর্ড। আর এ ক্ষেত্রে ইউজিসির নির্দেশনাও মানা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অস্থায়ী ও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের মেয়াদ শেষে বাদ দেওয়ার নজির নেই। পর্যায়ক্রমে তাঁদের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। একপর্যায়ে স্থায়ী হন।

ইউজিসির চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির নির্দেশনা মেনে চলবে, এটাই কাম্য। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দৈনিক মজুরি কিংবা অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। যদি তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তাহলে বিষয়টি যাচাই করে দেখা হবে।

উপাচার্যের শেষ সময়ে এসব নিয়োগ দেওয়ায় ভবিষ্যতে যিনি দায়িত্বে আসবেন, তিনি সমস্যায় পড়বেন বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি মুহাম্মদ সিকান্দার খান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, নির্দেশনা যদি না মেনে পারা যায়, তাহলে মানবে কেন? এ ক্ষেত্রে যাঁরা নির্দেশনা প্রয়োগ করেছেন, তাঁদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তাঁরা যদি যথাযথভাবে নির্দেশনা প্রয়োগ করতে পারতেন, তাহলে এ রকম অনিয়মের ঘটনা ঘটত না।