উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি, উল্টো বেড়েছে দুর্ভোগ

>

• দিনাজপুর পৌর শহর
• বিএনপি–সমর্থিত মেয়রের আট বছরের আমলে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি
• পৌরসভা এলাকার অবস্থা কোনোকালেই এত খারাপ ছিল না

শহরের রাস্তাগুলো চলাচলের অনুপযোগী, নালাগুলো অপরিষ্কার, অলিতে–গলিতে ছড়িয়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। দখল-দূষণে শহরের দুটি খালে পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একমাত্র শিশুপার্কটি বেহাল। শহরজুড়ে ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশার দৌরাত্ম্য। সব মিলিয়ে দিনাজপুর পৌর এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগের সীমা নেই।

টানা দুই মেয়াদে আট বছরের বেশি সময় ধরে পৌরসভার মেয়রের দায়িত্বে আছেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক। বিএনপি–সমর্থিত এই মেয়রের দাবি, এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে আট বছরে বিশেষ কোনো বরাদ্দ পাননি। তবে বরাদ্দ না পাওয়ায় মেয়রের ‘অযোগ্যতা’ও দায়ী বলে অভিযোগ অনেকের।

পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পৌর এলাকায় গত কয়েক বছরে নতুন সড়ক হয়নি বললেই চলে। সংস্কার না হওয়ায় অধিকাংশ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী। কিছু এলাকার বাসিন্দারা সড়ক সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানের মতো কর্মসূচিও পালন করেছেন।

পৌরসভার কোতায়ালি থানার পেছন থেকে নিমতলা পর্যন্ত, সুইহারী, ষষ্ঠীতলা, চারুবাবুর মোড়, রামনগর, ঘাসিপাড়া, বটতলী থেকে কাঁটাপাড়া, ক্ষেত্রীপাড়া ছয় রাস্তা, পুলহাট পুলিশ ফাঁড়ি, লালবাগ, বাহাদুরবাজার গোলকুঠি এলাকার বেশির ভাগ রাস্তাই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ১২টি ওয়ার্ডের প্রায় সব কটির রাস্তাঘাটই এমন ভাঙাচোরা ও এবড়োখেবড়ো।

১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অনুপযোগী। ওয়ার্ডের রামনগর এলাকার সড়কজুড়ে বড় বড় গর্ত। পানিনিষ্কাশনের নালা আবর্জনায় ভরা। দিনাজপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মেসবাহুল হক বলেন, এই এলাকায় অনেক শিক্ষার্থী ভাড়া থাকে। ভাঙা রাস্তার কারণে প্রতিদিন যাতায়াতে কষ্ট হয়। একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা হয়। ড্রেনের গন্ধ, রাতে মশার উপদ্রব।

পৌরসভার মোট রাস্তার পরিমাণ প্রায় ১৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১২২ কিলোমিটার পাকা আর ৪৪ কিলোমিটার কাঁচা। ৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার কংক্রিটের (আরসিসি) এবং ছয় কিলোমিটার ইট বিছানো। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সড়ক সংস্কারে ছয় কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা একেবারেই কম।

পৌরসভার কর্মকর্তা ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেয়র জাহাঙ্গীর আলম প্রথম দফায় দায়িত্ব নেওয়ার আগে বিদেশি দাতা সংস্থার একটি প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে পৌরসভাকে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়; যা দিয়ে রাস্তা, নালা ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জাহাঙ্গীর দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নানাভাবে পৌরসভার বরাদ্দ আটকে দিয়ে উন্নয়নকাজকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এলাকার রাস্তাঘাট ভাঙা, ড্রেনেজ–ব্যবস্থা দুর্বল। এগুলো সংস্কারে এবং নাগরিক সুবিধা দিতে সরকারের কাছ থেকে যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা পাওয়া যাচ্ছে না। পৌরসভার রাজস্ব খাত থেকে যথাসম্ভব চেষ্টা করা হয়।

শহরের ঘাগড়া ও গিরিজা খাল দুটি দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। খালের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে স্থায়ী স্থাপনা। দখল হতে হতে সরু নালায় পরিণত হয়েছে। পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। দুর্ভোগে পড়ছে শহরের মানুষ।

শহর ঘুরে দেখা যায়, সুইহারী, পাটুয়াপাড়া, গোলাপবাগ, বড়বন্দর, জোড়াব্রিজ, বালুবাড়ি এলাকায় খালের জায়গা দখল করে স্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সদর উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়ের করা তালিকা অনুযায়ী, ঘাগড়া খালে অবৈধ দখলদার ৩৭৫ জন এবং গিরিজা খালে ২৪৫ জন। দেশের উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত হলেও ২০১৭ সালের আকস্মিক বন্যায় দিনাজপুর শহর ডুবে যায়। খাল দুটিতে পানির প্রবাহ না থাকায় বন্যা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছিল বলে মনে করে শহরবাসী।

এ বিষয়ে পৌর মেয়র বলেন, ঘাগড়া খাল সংস্কারের জন্য তিন কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কাজ শুরু করা যায়নি। ক্ষমতাশালী কিছু মানুষ অবৈধভাবে খালের জায়গা দখল করেছে। এসব উচ্ছেদে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় পৌর এলাকার একমাত্র শিশুপার্কটির বেহাল। গত মঙ্গলবার শিশুপার্কটি ঘুরে দেখা যায়, পার্কজুড়ে গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। স্লিপারটি ভেঙে পড়েছে। চালানোর মতো অবস্থায় না থাকায় চরকি ঘুটিয়ে রাখা হয়েছে। পার্কে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রবেশমুখের পাশে একটি বিশ্রামাগার আছে।

১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পার্কে কয়েকটি দোলনা, স্লিপার, চরকি, ফোয়ারা দিয়ে সজ্জিত ছিল। কিন্তু গত সাত-আট বছরের অবহেলায় পার্কটি এখন আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। সন্ধ্যা হলে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে বলে জানান স্থানীয় লোকজন।

জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শফিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দিনাজপুর পৌর এলাকার অবস্থা কোনোকালেই এত খারাপ ছিল না। অন্য অনেক পৌর মেয়র বিএনপির হলেও বরাদ্দ পাচ্ছেন। বর্তমান মেয়র নিজের অযোগ্যতাকে ঢাকার জন্য বরাদ্দ না পাওয়ার কথা বলেন। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে মেয়রকে আরও তৎপর হতে হবে।