বাড়ির ছাদে যোদ্ধা মোরগ

মগবাজারে নিজের বাড়ির ছাদে পোষা যোদ্ধা মোরগের সঙ্গে ইমতিয়াজউদ্দীন।  ছবি: প্রথম আলো
মগবাজারে নিজের বাড়ির ছাদে পোষা যোদ্ধা মোরগের সঙ্গে ইমতিয়াজউদ্দীন। ছবি: প্রথম আলো

চারতলা বাড়ির ছাদে সুপরিসর খাঁচা ও বড় ফোকরযুক্ত কাঠের বাক্সে আটকানো মোরগগুলো প্রায় পালকহীন। নগ্ন বুক। মাঝেমধ্যে পলক পড়লে চোখগুলো ঢেকে যাচ্ছে সাদা পর্দায়। মাংসল ও পেশিবহুল পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একেকটি মোরগ যেন চৌকস কোনো দৌড়বিদের ভাস্কর্য।

মগবাজার তালতলা গলির তরুণ ব্যবসায়ী মো. ইমতিয়াজউদ্দীন বাড়ির ছাদে এমন সাতটি মোরগ পুষছেন। এগুলো জাতে ‘আসলি’ বা যোদ্ধা মোরগ। ‘আসিল মোরগ’ নামেও পরিচিতি আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত মোরগ লড়াই এখনো জনপ্রিয় একটা খেলা। উৎসব-পার্বণসহ নানা লোকজ ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে অনেকে এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেসব প্রতিযোগিতায় নিজের মোরগ নিয়ে ছুটে যান ইমতিয়াজউদ্দীন।

সম্প্রতি ইমতিয়াজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হয় তালতলা গলিতে তাঁর বাসভবনের সামনেই। তিনি তখন একটি মোরগ কোলে নিয়ে তাঁর বাবার সঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। কৌতূহলী জিজ্ঞাসায় তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, লড়াইয়ের জন্য মোরগ পালন তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য। একসময় তাঁর দাদা এই মোরগ পুষেছেন, বাবারও শখ ছিল মোরগ লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার। এখন তিনি পালন করেন। কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, মগবাজার এলাকার দিলু রোডের নামকরণ হয়েছে যে দিলু ব্যাপারীর নামে, তাঁর ছেলেদেরও এই মোরগ পালনের শখ ছিল। ইমতিয়াজউদ্দীনের দাদা শামসুদ্দিন ব্যাপারী ছিলেন দিলু ব্যাপারীর বড় নাতি।

ছাদে গিয়ে দেখা গেল, এমন সাতটি মোরগের সঙ্গে তিনটি মুরগিও আছে। এর কয়েকটি তিনি সংগ্রহ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল এলাকা থেকে। বাকিগুলো বাড়িতেই ডিম ফুটে ছানা হয়েছে। এর মধ্যে সাদা পালকের ‘জাওয়া আসলি’ মোরগটার লড়াইয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা হয়েছে। যে কারণে এটার বাজারদর এখন ৫০ হাজার টাকার বেশি। ইমতিয়াজউদ্দীনের বক্তব্য, এটাই আসল আসলি। অন্য রঙের যে মোরগগুলো দেখা যায়, সেগুলো মিশ্র জাতের। যেমন লাকা আসলি, মুরগিপর আসলি, কালো আসলি ইত্যাদি।

কথাবার্তায় জানা গেল, মোরগ লড়াইয়ের মৌসুম শুরু হয় ডিসেম্বর থেকে। চলে জুন-জুলাই পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৪০টির মতো ক্লাব আছে, যারা এ ধরনের লড়াইয়ের আয়োজন করে। ইমতিয়াজউদ্দীন নিজে বছিলার ‘বাংলাদেশ আসলি মোরগ উন্নয়ন সংস্থার’ একজন সদস্য। প্রতিযোগিতার অন্তত এক মাস আগে ক্লাবগুলো একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পারস্পরিক আলোচনা ও সম্মতির ভিত্তিতে স্থান নির্ধারিত হয়। সে অনুসারে ক্লাবের সদস্যরা লড়াইয়ের জন্য নিজেদের মোরগগুলোকে তৈরি করেন।

কথিত আছে, মোগল আমলে সরাইলের এক দেওয়ান সূদুর ইরান থেকে একধরনের যুদ্ধবাজ মোরগ এ দেশে নিয়ে আসেন। যা পরবর্তী সময়ে আসলি মোরগ নামে পরিচিতি পায়। সে সময় দেওয়ানদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এই অঞ্চলে মোরগ লড়াইয়ের গোড়াপত্তন ঘটে। যা পরে দেশের অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তাঁর ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে বলেছেন, ঢাকার আদি এই প্রতিযোগিতা মোগল আমলের শেষ দিকে অব্যাহত ছিল। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ছিলেন মোরগ লড়াইয়ের পৃষ্ঠপোষক। তাই একে শাহি শখ বলা হতো। ধনীদের এই আয়োজনে অংশ নিত ভিনদেশি জাতের মোরগ। আর দেশি মোরগের লড়াই ছিল সাধারণের আয়োজন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণত কোনো প্রতিযোগিতার আগে নিজের সংগ্রহে থাকা মোরগগুলোর মধ্যে লড়াই বাধিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী মোরগটিকে বাছাই করা হয়। এরপর চলে বিশেষ প্রশিক্ষণ। একটা মোরগ কমপক্ষে দুই ঘণ্টা লড়াই করতে পারে। আর চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ের নির্ধারিত সময় ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। লড়াইয়ের পর দীর্ঘ সময় মোরগগুলোকে খুব যত্নে রাখতে হয়। যেমন গরম সেঁক দেওয়া, মালিশ করা, ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ানো। সাধারণত ভালো জাতের এক দিনের একটা বাচ্চা মোরগ ৫০০ থেকে কয়েক হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আর লড়াইয়ের উপযোগী পূর্ণবয়স্ক একটা মোরগের দাম নির্ধারণ করে জাত ও লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার ওপর। এ ক্ষেত্রে মোরগটি কতগুলো লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে, কতগুলো লড়াই জিতেছে, এসব বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই নিরিখে পূর্ণবয়স্ক মোরগের দাম লাখ টাকায় উঠতে পারে।