মুরগির খামারে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনের নিয়ম উপেক্ষা

সেনাবাহিনীর নায়েক পদ থেকে অবসরে আসার পর আলমগীর হোসেনের বাড়িতে মুরগির খামার করেন। এখন এ খামারে দুই হাজার লেয়ার মুরগি। খামারের বিষ্ঠা যাচ্ছে তাঁর বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে। মুরগির ডিম বিক্রির আয়ের পাশাপাশি বায়োগ্যাসে বাড়ির চুলা ও বাতি জ্বালাচ্ছেন তিনি। অথচ মাত্র ৫০ গজ দূরে রয়েছে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক সাইফুল ইসলামের লেয়ার মুরগির খামার। সেখানেও দুই হাজার মুরগি। আশপাশে দাঁড়ালে ঝাঁজালো দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। কারণ, তাঁর খামারে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নেই।

দুটো খামারই নরসিংদীর বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়নের রাজারবাগ গ্রামের। শুধু এই গ্রামে নয়, পুরো বেলাববাসীই এখন মুরগির খামারের দুর্গন্ধের মধ্যে বসবাস করছে। আর আতঙ্কের বিষয় হলো, দুর্গন্ধ তাদের গা-সহা হয়ে গেছে। সম্প্রতি দুই দিন উপজেলা সরেজমিনে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, লাল মাটির পাহাড়ি এলাকা আর উঁচু জমির কারণে বেলাব মুরগির খামারের জন্য খুবই উপযুক্ত। ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি—এই তিন ধরনের মুরগির খামার আছে এখানে। ডিম উৎপাদনের জন্য লেয়ার এবং মাংস উৎপাদনের জন্য ব্রয়লার ও সোনালি জাতের মুরগির খামার করা হয়। ব্রয়লার ও সোনালি জাতের মুরগির খামারে তেমন দুর্গন্ধ না থাকলেও লেয়ার মুরগির খামারে তীব্র দুর্গন্ধ হয়। দুর্গন্ধ কমানোর জন্য বাজারে কিছু ওষুধ পাওয়া যায়। আর বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের মাধ্যমেও এই দুর্গন্ধ কমানো যায়। কিন্তু কিছুটা ব্যয়সাপেক্ষ বলে অধিকাংশ খামারি বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে উৎসাহিত হন না।

স্থানীয় কয়েকজন খামারি জানান, উপজেলায় খামারের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ হাজার। স্থানীয় পর্যায়ে শিল্পকারখানা না থাকায় বেকারত্ব কমাতে স্থানীয়রা মুরগির খামারের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। গত বছর খামারিদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হলেও এবার লাভের মুখ দেখছেন ব্যবসায়ীরা। প্রবাসজীবন শেষ করে এসেও কাউকে কাউকে খামার করতে দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি খামার আছে রাজারবাগ গ্রামে।

রাজারবাগ গ্রামের লেয়ার মুরগি পালনকারীদের সমিতির সভাপতি কাজল মিয়া জানান, লেয়ার মুরগির খামারে ঝাঁজালো দুর্গন্ধ থাকবেই। খামারের সঙ্গে যদি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করা যায়, তবেই এসব দুর্গন্ধ কমানো সম্ভব। শুধু আমলাব ইউনিয়নেই প্রায় দুই হাজার মুরগির খামার আছে। তবে হাতে গোনা কয়েকটি বাদে অধিকাংশ খামারেই বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজারবাগ গ্রামের অধিকাংশ খামারের আশপাশে মুরগির বিষ্ঠা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। খামারের পাশেই বসতবাড়ি। তীব্র দুর্গন্ধে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একটি মুরগির খামার স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং জনগণের ক্ষতি হয়, এমন স্থানে খামার স্থাপন করা যাবে না। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় অবস্থিত খামারের বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা নেই।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাড়ির মধ্যে খামার না করা, লোকালয় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে খামার করা, অবশ্যই বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট রাখা ও নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। আগে থেকেই অপরিকল্পিতভাবে করা এসব খামারের অধিকাংশেরই কোনো নিবন্ধন নেই। সরকারি ভর্তুকি বা সুযোগ-সুবিধা পান না বলে খামারিরা নিবন্ধনের বিষয়ে উৎসাহী হন না। পুরো উপজেলায় মাত্র ২৫২টি খামারের নিবন্ধন আছে। অথচ প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মাংস ও ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে পোলট্রি জোন হিসেবে নরসিংদী জেলা সারা দেশে দ্বিতীয়। জেলার মধ্যে শিবপুর ও বেলাব উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পোলট্রি খামার রয়েছে।

নরসিংদী সরকারি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী বটেশ্বর গ্রামের পিয়ানো খানম বলেন, খামারিরা অভ্যস্ত হয়ে গেলেও এই দুর্গন্ধের কারণে আশপাশের মানুষের বেশি সমস্যা হচ্ছে। এলাকার অধিকাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য মুরগির খামার করেন। তাই এলাকাবাসীর প্রতিবাদের তেমন সুযোগ নেই। প্রতিটা খামারের সঙ্গে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট যুক্ত করতে পারলে তীব্র দুর্গন্ধ থেকে বাঁচা যেত, আবার গ্যাসও কাজে লাগত।

স্থানীয় তিনটি খামারের মালিক স্বপন চন্দ্র মোদক বলেন, দুর্গন্ধে ক্ষতি হলেও তেমন কিছু করার নেই। কৃষিকাজ আর খামার করা ছাড়া অন্য কোনো পেশা সেভাবে এই উপজেলায় নেই। তবে ইদানীং খামারিদের মধ্যে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বেলাব উপজেলা শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় দুর্গন্ধের বিষয়ে আমরা পুরোপুরি অ্যাকশনে যেতে পারছি না। নিয়মনীতির মধ্যে থেকে প্রত্যেক খামারি যেন মুরগি পালন করেন, আমরা সে চেষ্টা করছি। তবে ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সমসের জামান ভূঁইয়া বলেন, প্রত্যেক খামারিকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট যুক্ত করেই খামার তৈরি করতে হবে, না হলে সামনের দিনগুলোতে এসব খামারের দুর্গন্ধ স্থানীয়দের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রশাসনের উচিত এ বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া।

জানতে চাইলে ইউএনও শামীমা শরমীন গতকাল রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনের সময় দুর্গন্ধের বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। বিষয়টির সমাধানের জন্য উপজেলা সমন্বয় সভায় আমরা আলোচনা করব।’