ছেলেদের পেছনে ফেলে আরও এগিয়ে মেয়েরা

এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পায়নি সামিয়া, পেয়েছে জিপিএ–৪.৭২। তবু মায়ের খুশির কমতি নেই। ফলাফল শুনে মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দেন মা। গতকাল রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে ফল প্রকাশের পর।  ছবি: হাসান রাজা
এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পায়নি সামিয়া, পেয়েছে জিপিএ–৪.৭২। তবু মায়ের খুশির কমতি নেই। ফলাফল শুনে মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দেন মা। গতকাল রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে ফল প্রকাশের পর। ছবি: হাসান রাজা
>

• এসএসসিতে গড় পাসের হার ৮২.৮০
• পাসের হার ৩.৪০ শতাংশ বেড়েছে
• এবারের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ কমেছে
• জিপিএ-৫ কমেছে ৮ হাজার ২৮৯
• দুই সূচকেই মেয়েরা এগিয়ে আছে

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের অংশগ্রহণ ও সফলতার চিত্র দৃশ্যমান। এর মধ্যে বড় অগ্রগতি মাধ্যমিক স্তরে, যেখানে প্রায় প্রতিবছরই ছাত্রীরা নিজেদের গড়া রেকর্ড অতিক্রম করছে। এ বছরও মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ ৫—দুই সূচকেই ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এমনকি বিজ্ঞানশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়ছে।

এবার ফলাফলের ভালো–মন্দ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রেখেছে গণিত। যেসব বোর্ডে পাসের হার কমেছে বা পিছিয়ে আছে, সেগুলোর শিক্ষার্থীরা গণিতে খারাপ করেছে। যদিও আরেক ‘কঠিন’ বিষয় ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। সব বোর্ডেই ইংরেজিতে পাসের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। এসএসসি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন অভিভাবকেরা ছেলে–মেয়েকে আলাদাভাবে দেখেন না। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে বাবা-মা ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। তবে তাঁদের মতে, প্রান্তিক পর্যায়ে এখনো মেয়েরা পিছিয়ে। আর গণিতের বড় সমস্যা হলো মানসম্মত পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই।

৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার গতবারের চেয়ে ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ। ১৬ লাখ ৯৪ হাজার ৬৫২ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছে ১৪ লাখ ৩ হাজার ১৫৭ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৪ হাজার ৫৫৬ জন, যা পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ৮৪৫ জন। এবারের পরীক্ষায় পাসের হার বাড়লেও ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ গত বছরের তুলনায় কমেছে ৮ হাজার ২৮৯।

গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এসএসসি, দাখিল ও এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। এই তিন পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরে থাকায় ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে মুঠোফোনে কথা বলে ও বাণী দিয়ে পাস করা শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান। আর যারা পাস করতে পারেনি, তাদের সাহস দিয়েছেন তিনি। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সোহরাব হোসাইন, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর প্রমুখ।

ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার এসএসসিতে ছাত্রীদের পাসের হার ৮৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আর ছাত্রদের পাসের হার ৮২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। ৪৮ হাজার ৫৯১ জন ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। আর ছাত্ররা পেয়েছে ৪৫ হাজার ৯৬৫ জন। এ বছর ৮ বোর্ডে ছাত্রদের চেয়ে ২ হাজার ৬২৬ জন ছাত্রী বেশি জিপিএ-৫ পেল।

কেবল ৮ বোর্ডেই নয়, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়েও ছাত্রীরা পাসের হার ও জিপিএ–৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, এখন সব মা–বাবাই চান তাঁর মেয়েটিও (যদি থাকে) পড়াশোনা করুক। এখানে উপবৃত্তি বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি আরও বলেন, পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হওয়ায় শিক্ষার ওপরের স্তরেও মেয়েরা ভালো করছে। কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, শহরকেন্দ্রিক সচেতনতা বেশি বাড়লেও প্রান্তিক এলাকায় এখনো মেয়েরা পিছিয়ে আছে। মাধ্যমিকে মেয়েদের ঝরে পড়ার হারও বেশি, যাদের বেশির ভাগই প্রত্যন্ত এলাকার। এ জন্য ওই সব এলাকায় বিশেষ নজর দিতে হবে।

এবার বিজ্ঞানে মোট পরীক্ষার্থী ছিল প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। এর মধ্যে ছাত্রী ছিল প্রায় আড়াই লাখ। কয়েক বছরে বিজ্ঞানে ছাত্রীদের পড়ার আগ্রহ বেড়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মূল্যায়ন হলো, আগে মেয়েরা বিজ্ঞান শাখায় তুলনামূলক কম আসত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শাখায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। আর জিপিএ-৫ সাধারণত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাই বেশি পায়। ফলে মেয়েদের জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে।

বিজ্ঞানে পাস ও জিপিএ–৫ বেশি
৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা মিলিয়ে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৪ হাজার ৫৫৬ জন। এর মধ্যে ৯১ হাজার ৩৩ জনই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। অর্থাৎ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৬ দশমিক ২৭ শতাংশই বিজ্ঞানের। ব্যবসায় শিক্ষায় ২ হাজার ৮৭ জন এবং মানবিক শাখা থেকে ১ হাজার ৪৩৬ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।

পাসের হারেও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে। এসএসসিতে গড় পাসের হার যেখানে ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ; সেখানে বিজ্ঞানে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। মানবিকে পাসের হার ৭৪ দশমিক ৩২ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ৮৩ শতাংশ।

গণিত নিয়ামক
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফলাফল ভালো–মন্দ নির্ধারণে গণিতই বড় ভূমিকা রেখেছে। যেমন সব বোর্ডে পাসের হার বাড়লেও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার প্রায় ২ শতাংশ কমেছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, এই বোর্ডে এবার গণিতে পাসের হার অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কম। গণিতে এবার এই বোর্ডে ৮৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে। যেখানে অন্য বিষয়ে পাসের হার ৯১ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত। গতবার এই বোর্ডে গণিতে পাসের হার ছিল প্রায় ৮৮ শতাংশ।

আবার পাসের হারে তলানিতে থাকা সিলেট শিক্ষা বোর্ডে গণিতে পাসের হার মাত্র ৭৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে গণিতে পাসের হার প্রায় ৮২ শতাংশ। এই বোর্ডে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা ৮ বোর্ডের গড় পাসের হারের চেয়ে ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ কম। পিছিয়ে থাকা চট্টগ্রাম বোর্ডেও গণিতে পাসের হার কম।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মূল্যায়ন করে দেখেছেন, মূলত গণিতে পাসের হার গতবারের চেয়ে কমে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ঢাকা বোর্ডের পাসের হারের ওপর। সব বোর্ডের গড় পাসের ওপরও প্রভাব ফেলেছ গণিতের ফল।

পিছিয়ে মফস্বল
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ঢাকাসহ ১৭টি জেলার শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। জেলাভিত্তিক ফলাফল মূল্যায়নে দেখা গেছে, মফস্বলের জেলাগুলোর শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে। বিপরীতে ঢাকা মহানগরী, ঢাকা জেলা ও পার্শ্ববর্তী গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। যেমন ঢাকা মহানগরীতে পরীক্ষা দিয়েছিল ৯৩ হাজার ৩০৭ জন। তাদের মধ্যে ৮৮ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। যার মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪০১ জন। অথচ ১৭ জেলায় মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ৬৮৭ জন।

অন্যদিকে মাদারীপুরে পাসের হার ৬৬ দশমিক ৫১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ২১৫ জন। ফরিদপুরে পাসের হার ৬৭ শতাংশ ও জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪০৬ শতাংশ। অথচ ঢাকা বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৯ দশমিক ৬২ শতাংশ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সূত্রমতে, অন্য বোর্ডের চিত্রটিও কমবেশি একই ধরনের।

বিদেশের কেন্দ্রে পাস ৯২ শতাংশ
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন বিদেশের ৮টি কেন্দ্রে গড় পাসের হার ৯১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এসব কেন্দ্রে অংশ নিয়েছিল ৪২৩ জন। এর মধ্যে পাস করেছে ৩৮৯ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৬ জন।

কেন্দ্রগুলো হলো জেদ্দার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, রিয়াদের বাংলাদেশ এমবাসি স্কুল, ত্রিপোলির বাংলাদেশ কমিউনিটি স্কুল, দোহার বাংলাদেশ মাশহুর-উল-হক মেমোরিয়াল হাইস্কুল, আবুধাবির শেখ খলিফা বিন জায়েদ বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল, বাহরাইনের বাংলাদেশ স্কুল, রাস আল খাইমার বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল এবং ওমানের সাহামের বাংলাদেশ স্কুল।

সেরা রাজশাহী, পিছিয়ে সিলেট
৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের ফল তুলনা করে দেখা যায়, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা এবারও পাসের হারে এগিয়ে। এই বোর্ডে পাসের হার গতবারের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। পাসের হারে গতবারও এই বোর্ড এগিয়ে ছিল।

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহী বোর্ড ধারাবাহিকভাবেই ভালো করছে। তাঁর মূল্যায়ন হলো, তাঁদের বোর্ডের অধীন রাজশাহী জেলা ছাড়াও বগুড়া ও পাবনার শিক্ষার্থীরা ভালো করছে। তদারক ব্যবস্থাটা জোরদার রাখছেন।

আবার সিলেট বোর্ড গতবারের মতোই সবচেয়ে পিছিয়ে। এসএসসিতে গড় পাসের হার যেখানে প্রায় ৮৩ শতাংশ, সেখানে সিলেটে এই হার ৭০ দশমিক ৮৩। অবশ্য ঢাকা বাদে বাকি সব বোর্ডেই গতবারের চেয়ে পাসের হার কিছু বেড়েছে।

এবার ১০৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি। তবে ২ হাজার ৫৮৩টি প্রতিষ্ঠানের সবাই পাস করেছে।