মাছমারা খালে 'মানুষমারা' সেতু

বাগেরহাটের মোংলা বন্দর পৌরসভার মাছমারা খালের ওপরের কাঠের সেতুটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ। শিশুরা এটি পার হয় ভয়ে ভয়ে। গত সোমবার মাছমারা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
বাগেরহাটের মোংলা বন্দর পৌরসভার মাছমারা খালের ওপরের কাঠের সেতুটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ। শিশুরা এটি পার হয় ভয়ে ভয়ে। গত সোমবার মাছমারা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

বাগেরহাটের মোংলা বন্দর পৌরসভার মোংলা নদী–সংলগ্ন গ্রাম মাছমারা। এই গ্রামের মাছমারা খালে কাঠের সেতুটি চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। কোনো বাহন চলাচল তো দূরের কথা, এটি দিয়ে মানুষ পার হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। বয়স্ক ও শিশুদের জন্য এটি যেন মরণফাঁদ।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে সংস্কার না করায় সেতুটির এ অবস্থা। এ জন্য খালের দুই পাশে পৌরসভা এবং উপজেলার চাঁদপাই ও সোনাইলতলা ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের স্কুলের ছাত্রছাত্রীসহ কয়েক হাজার মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বছর দুই আগে এই সেতু থেকে পড়ে গিয়ে এক বৃদ্ধা নিহত হন। দুই বছর ধরে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটলেও কাঠের সেতুটি সংস্কারে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না পৌর কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি একটি সংস্থা সেতুটি নির্মাণ করে দিয়েছিল বলেই পৌরসভার এই অনীহা বলে জানা যায়।

গত সোমবার মাছমারা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কাঠের সেতুটির অধিকাংশ স্থানই ভাঙাচোরা। কাঠের পাটাতন নেই বললেই চলে। লোহার কাঠামোর সঙ্গে কোথাও মাঝখানে সরু একটি কাঠ, আবার কোথাও দুই পাশে দুটি সরু কাঠের ওপর দিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে লোকজন সেতুটি পার হচ্ছে।

মাছমারা গ্রামের সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শেফালী বিশ্বাস ও নারকেলতল গঠন এডুকেশন সেন্টারের প্রধান শিক্ষিকা প্রীতি বালা বলেন, ‘পৌরসভা ও পার্শ্ববর্তী চাঁদপাই ও সোনইলতলা ইউনিয়নের জয় খাঁ, পাকখালী, মাকঢ়ঢোন, মাছমারা ও নারকেলতলা গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার বাসিন্দা এ সেতু পার হয়ে মোংলা শহরে যাতায়াত করে। দুই বছর ধরে সেতুটির কোনো সংস্কার না করায় আমরা খুবই বিপদের মধ্যে আছি। এই সেতুর দুই পারের তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতু পার হয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয় ও কলেজে আসা-যাওয়া করতে হয়। এই ভাঙাচোরা সেতুর কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।’

স্কুলগামী শিশুরা সেতুটি পার হয় অত্যন্ত ভয় নিয়ে! কারণ, পা ফসকে গেলেই খালে পড়ে প্রাণহানি ঘটবে! গঠন এডুকেশন সেন্টারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জিয়ারুল শেখ, সৈকত আকন, মনিরুল, সুমন ফরায়েজীসহ প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী বলে, বাবা-মা বা অভিভাবক সঙ্গে না থাকলে তারা খুবই ভয়ে ভয়ে এই সেতু পার হয়। একটু বৃষ্টি হলেই সেতুর ওপর এমন পিচ্ছিল হয় যে তাদের মতো শিশুরা তখন আর সেতু পার হতে পারে না। সামনে বর্ষা মৌসুম আসার আগে এই সেতু ঠিক না করলে তাদের বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

নারকেলতলা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ এনায়েত তালুকদার, মো. আনোয়ার শেখ ও মাছমারা গ্রামের ভ্যানচালক জীবন বিশ্বাস বলেন, ২০১৭ সালে এই সেতু পার হওয়ার সময় কুলসুম বেগম নামের এক বৃদ্ধা পড়ে গিয়ে মারা যান। এটি এখন মানুষমারার সেতুতে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহেও জনি বিশ্বাস নামের একজন মোটরসাইকেল নিয়ে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। ছোটখাটো দুর্ঘটনা তো প্রায়ই ঘটছে। তাঁরা আরও বলেন, দিনের বেলায় কষ্ট করে পার হলেও রাতের বেলায় বৈদ্যুতিক বাতি না থাকায় সেতুটি দিয়ে কোনোভাবেই পার হওয়া যায় না। বৃদ্ধ ও শিশুদের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি।

 ‘মোংলা বাজার থেকে আমাদের পণ্য কিনে আনতে হয়। আর এই সেতু দিয়ে পণ্য পরিবহনে আমাদের ভীষণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এত দিন ধরে সমস্যা চললেও পৌর কর্তৃপক্ষ এই সেতুটি মেরামতের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করছে না।’ বলেন নারকেলতলা গ্রামের মুদি দোকানি মাসুম শেখ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোংলা বন্দর পৌরসভার মেয়র জুলফিকার আলী বলেন, ‘সেতুর এই দুরবস্থার কথা আমার জানা ছিল না। এলাকাবাসীও আমাকে এ বিষয়ে মৌখিক বা লিখিতভাবে কিছুই জানায়নি। মূলত সেতুটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন নির্মাণ করে দিয়েছিল। এরপর একবার তারা সংস্কারও করে দেয়। সে কারণে পৌর কর্তৃপক্ষ এর সংস্কারকাজ করেনি। এখন যদি সেই সংস্থা কাজ না করে, তবে পৌর কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই সেতু সংস্কারের ব্যবস্থা নেবে।’