চারদিকে পানি আর পানি তবু তেষ্টার জল নেই

খুলনার কয়রা উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তরে বামিয়া গ্রাম। পিচঢালা রাস্তার পাশেই অচিন কুমার রায়ের পুকুর। প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো পুকুরটা মজা।
পানি শুকিয়ে পুকুরের তলায় গিয়ে ঠেকেছে। রং হালকা সবুজ। পাড় ভেঙে মাটি ধসে পড়ছে। পাড়ের নারকেল, খেজুর, বেল, আম, কলার পাতা খসে পানিতে ভাসছে।
দুই হাতে আবর্জনা সরিয়ে ১৫ লিটারের কলসি ভরলেন খালেদা বেগম। কলসি কাঁখে খাড়া ঢাল বেয়ে পাড়ে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি। বয়স তাঁর ৫০ পেরিয়েছে।
বাড়ি ফিরতে খালেদার ৩৫ মিনিট লাগল। আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে তিনি বললেন, ‘বিকেলে আবার যাতি হবে।’ বাড়ির পাশে একটি নলকূপ বসিয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের লোকজন। কিন্তু ‘কলের পানি জম্মের নোনা।’
খালেদার বাড়ি কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের মাদারবাড়িয়া গ্রামে। ছয় সদস্যের দরিদ্র পরিবারটিতে নিত্যকাজের পানি জোগানো খালেদার দায়িত্ব। ধোয়াপালার পানি তিনি আনেন আত্মীয়ের পুকুর থেকে। গোসল চলে শরিকের পুকুরে। আর খাওয়ার পানি বামিয়া গ্রামের পুকুরটি থেকে।
পুকুরের মালিক অচিন কুমারের হিসাবে, দুই গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার এভাবে পানি নেয়। পানির টানাটানি তীব্র হয় গ্রীষ্মে।
মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের দুই সদস্য জানিয়েছেন, বামিয়ায় পাঁচ হাজার ও মাদারবাড়িয়ায় আড়াই হাজার মানুষের বসবাস। খাওয়ার পানির পুকুর মাত্র তিনটি, সব কটিই বামিয়ায়।

পানি আছে, পানি নেই
জেলার সবচেয়ে দক্ষিণের উপজেলা কয়রায় বড় দুই নদী—কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া। চিংড়িঘেরগুলোতে থইথই পানি। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) উপসহকারী প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার পাল বলেন, ‘উপজেলায় পানির অভাব নেই। অভাব খাওয়ার পানির।’
অধিদপ্তরের হিসাবে উপজেলার ৪৫ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায় না, পুকুরের পানি খায়। আদতে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার কমপক্ষে নয়টি উপজেলার উপকূলজুড়ে বহু গ্রামে পানীয় জলের সংকট চলছেই।
উপজেলাগুলো হচ্ছে যথাক্রমে কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা; শরণখোলা, রামপাল ও মোংলা; আশাশুনি, শ্যামনগর ও দেবহাটা। পাইকগাছা ও আশাশুনিতে আর্সেনিকের প্রকোপও আছে। সাতক্ষীরার আরও কিছু অঞ্চলে আর্সেনিক প্রকট সমস্যা।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের জেলা পর্যায়ের সূত্রগুলো বলেছে, খুলনার ২২ শতাংশ, সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ এবং বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। এলাকা যত দক্ষিণে, সংকট তত গভীর।
কিছু এলাকায় লোনাপানির চিংড়ি চাষের কারণে অন্তত চার দশক ধরে অনেক সুপেয় পানির পুকুর নষ্ট হয়েছে। পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লোনাপানির প্রভাব সব সময়ই ছিল। ক্রমে নদ-নদী, পুকুরসহ জলাশয়ের পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে।
সুন্দরবনসংলগ্ন এই জনপদে পানীয় জলের বড় উৎস ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় লোনাপানির তোড়ে বহু পুকুর ভেসে যায়। ১০ বছরেও বেশির ভাগেরই সংস্কার হয়নি।
আইলার পর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ইউনিসেফ আর দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা গ্রামে গ্রামে নলকূপ, পুকুরে বালুর ফিল্টার (পিএসএফ) আর পাতন (আরও) প্রযুক্তি দিয়েছিল। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে বলেছিল।
ডিপিএইচইর উপসহকারী প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার প্রথম আলোকে বলেন, কয়রা উপজেলার যে ৫৫ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে, তা উল্লিখিত চারটি উৎস থেকে। তবে তাঁর এলাকায় গভীর বা সাধারণ কোনো নলকূপেই সুপেয় পানি পাওয়া যায় না। ইদানীং মাটির অনেক গভীরেও লোনাপানি পাওয়া যাচ্ছে।
তা ছাড়া অনেক যন্ত্র তদারকির অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। কয়রায় সরকারি-বেসরকারি গভীর নলকূপ আছে ২ হাজার ৪৯৬টি। তার ১৪৮টি নষ্ট। ২১৮টি বালুর ফিল্টারের মধ্যে মাত্র ২০টি চালু আছে।
এদিকে খুলনা জেলা ডিপিএইচইর নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ পারভেজ বলেছেন, পাইকগাছায় নতুন কিছু এলাকায় নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে।

লবণের সঙ্গে আর্সেনিক
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা গ্রামের বাসিন্দা দিবানন্দ দে যেমনটা বলেছেন, বহু পরিবার জেনেশুনে আর্সেনিকযুক্ত পানি খেতে বাধ্য হচ্ছে। আশাশুনি বাজারের হোটেলগুলোতে আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি খেতে দেওয়া হয়।
পূর্বপাড়ার রেহানা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছর আগে সরকারের লোকজন নলকূপে লাল রং লাগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক। কিন্তু তাঁরা পানির ব্যবস্থা করেননি।
আশাশুনি উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের জন্য প্রায় চার হাজার নলকূপ আছে। এর প্রায় অর্ধেকের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, পাঁচটি ইউনিয়নে একই সঙ্গে লবণাক্ততা ও আর্সেনিক বেশি।


পানি কেনাবেচা
আইলার পরপরই এলাকায় পানির সমস্যা তীব্র হয়। কয়রার মাদারবাড়িয়ার ভ্যানচালক মো. আবদুল আজিজ অনুমান করেছিলেন, বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিলে মানুষ পানি কিনবে।
আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, জয়পুর গ্রামে সরকারের দেওয়া গভীর নলকূপের পানি ভালো। সেখান থেকে তিনি সকাল-বিকেল ১০ ড্রাম করে পানি নিয়ে চার গ্রামে বিক্রি করেন। ৩০ লিটারের প্রতি ড্রাম পানির দাম ২০ টাকা।
এপ্রিলের গোড়ায় আরও চারজনকে ভ্যান চালিয়ে পানি ফেরি করতে দেখা গেছে। পাশের উপজেলা দাকোপে রাস্তাঘাট খারাপ। সেখানে পানিওয়ালারা যান নৌকায় করে।
দাকোপের সবচেয়ে দক্ষিণের জনপদ দক্ষিণ কালাবগি। সুন্দরবনঘেঁষা গ্রামটির দুই দিকে শিবসা ও ঢাকি নদী। দুটির পানিই লোনা।
শিবসার পাড়ে টংঘরে চার ছেলে নিয়ে বাস করেন আবিয়া খাতুন আর এসমত গাজী। আবিয়া বললেন, গ্রামের দু-তিনজন মানুষ প্লাস্টিকের ড্রামে করে উত্তরের ১০ কিলোমিটার দূরের গড়ইখালি বাজারের একটি পুকুর থেকে পানি ভরে গ্রামে আনেন। আবিয়াসহ অনেকেই এক টাকা লিটার দরে পুকুরের পানি কেনেন।
এই গ্রাম থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে একই উপজেলার বাজুয়া ইউনিয়নের কাঁকড়াবুনিয়া গ্রামে বৃষ্টির পানির ব্যবসা করছে শরিফস নামের একটি এনজিও। চার বিঘা জমিতে পুকুর কেটে তারা বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি ধরে রাখে।
এনজিওটি সারা বছর সেই পানি পাতন প্রক্রিয়ায় বিশুদ্ধ করে বিক্রি করে। দর দূরত্বভেদে এক থেকে দুই টাকা লিটার। এখন দিনে ৮-১০ হাজার লিটার পানি বিক্রি হচ্ছে।
বহু পরিবার বর্ষায় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সারা বছর তা ব্যবহার করে। বৃষ্টির পানি মূলত ঘরের চাল থেকে নল দিয়ে ধরা হয়। ডিপিএইচই প্রতিটি ইউনিয়নে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য কম দামে প্লাস্টিকের ট্যাংক দিচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও কিস্তিতে ট্যাংক বিক্রি করছে।
মাদারবাড়িয়া গ্রামের খালেদা বেগমের পরিবার সরকারের কাছ থেকে কোনো ট্যাংক পায়নি। কেনার সংগতিও নেই। অনেকের ঘরের চাল গোলপাতার, পচনশীল। সেই চাল চোয়ানো পানি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।

সমস্যা আর সমস্যা
এই এলাকার পুকুরের পানির মান নিয়ে কোনো তথ্য সরকারের কোনো দপ্তরে পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ মানুষ পুকুরের পানিতেই গোসল করে। নদীর পাড়ের মানুষ করে নদীর লোনাপানিতে।
কালাবগি গ্রামের আবিয়া বলেছিলেন, ‘লোনাপানিতে গোসলের পর সারা গা জ্বালা করে।’ বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ১০ জন বলেছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের শরীরে পাঁচড়া বা চুলকানি আছে।
কয়রা উপজেলা হাসপাতালের মেডিকেল কর্মকর্তা কুশল রায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন বহির্বিভাগে প্রায় ২০০ রোগী আসে। এদের মধ্যে ৩৫-৪০ জন চর্মরোগের কথা বলে, ৫০-৬০ জন বলে আমাশয়ের কথা।
এই হাসপাতালের সামনে লোনাপানি শোধনের জন্য একটি সরকারি পাতনযন্ত্র বা আরও আছে। রোগী, চিকিৎসক, নার্স—সবাই সেখান থেকে ৫০ পয়সা লিটার দরে পানি কিনে ব্যবহার করেন।
দাকোপ উপজেলা হাসপাতালে একটি পাতনযন্ত্র বসিয়েছে আন্তর্জাতিক এনজিও ওয়াটারএইড। এনজিওটি হাসপাতালে বিনা মূল্যে পানি দিচ্ছে।
সরকার ইতিমধ্যে সারা দেশে জেলা পরিষদের আওতাধীন পুকুরগুলো পুনঃখনন ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। দাকোপ ও কয়রায় এ রকম পুকুর খোঁড়া চলছে।
শিবসাপাড়ের আবিয়ার এলাকায় নলকূপ অকেজো। গ্রামের মানুষের খাওয়ার পানির উৎস একটিমাত্র পুকুর। এনজিও প্রদীপন চার বিঘা জমি কিনে এই পুকুর খুঁড়েছিল। কিন্তু এখন পুকুরের ওপর দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ হচ্ছে।
আবিয়া বলেন, ‘এই পুকুর রাস্তার তলে গেলি পানি না খাতি পারি মরে যাব।’