'এমন মা কয়জনার হয়?'

শাহানাজ বেগম
শাহানাজ বেগম

শরীয়তপুরের সরকারি আইন উদ্দিন কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক লুৎফর রহমান। মাকে নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বলেন, তাঁর বাবা যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স দুই বছর। বাবা মারা যাওয়ার পরপরই নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে তাঁরা নিঃস্ব হন। তিনি মায়ের ৩০ বছরের সংগ্রামী জীবনের সাক্ষী। মাকে কখনো বিচলিত হতে দেখেননি। মা পড়ালেখা না জানলেও তিনি–ই তাঁদের আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকায় ছিলেন।

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার দুর্গম পদ্মার চর চরভাগা গ্রামের বাসিন্দা শাহানাজ বেগম। বয়স ৬০ বছর। নিজে পড়ালেখা জানেন না। কিন্তু পড়ালেখা ছাড়া সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না তা তিনি বুঝতেন।

শাহানাজ ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩০ বছর আগে তাঁদের বাড়ি ছিল নড়িয়া উপজেলার মনিরাবাদ গ্রামে। দুই দফা নদীভাঙনের পর এখন ঠাঁই হয়েছে চরভাগা গ্রামে। স্বামী তাফসির আহম্মেদ পেশায় কৃষক ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি মারা যান। তখন শাহনাজ সন্তানসম্ভবা। ছয় শিশুসন্তান আর গর্ভে অনাগত সন্তান। ওই সময় নদীভাঙনে তাঁদের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ান শাহানাজ। আত্মীয়দের সহায়তায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে যান। শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। গবাদিপশু আর হাঁস-মুরগি পালন করে সংসারের খরচ মেটাতে থাকেন। সন্তানেরা বড় হতে থাকে।

শাহানাজের একটিই লক্ষ্য, সবাইকে তিনি শিক্ষিত করে নিজের পায়ে দাঁড় করাবেন। আজ তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর বড় ছেলে আবদুর রাজ্জাক সখীপুর ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। মেজ ছেলে ফজলুর রহমান একটি টেক্সটাইল মিলে চাকরি করেন। সেজ ছেলে বজলুর রহমান স্বাস্থ্য বিভাগে কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকরি করেন। আরেক ছেলে লুৎফর রহমান একটি সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। ছেলে জিয়াউর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর ছোট দুই ছেলে আবদুর রহমান ও আবদুর রহিম স্নাতকোত্তর পাস করেছেন।

শাহানাজ বলেন, তিনি সন্তানদের শিখিয়েছেন অভাব আর সংকটে কীভাবে ধৈর্য ধারণ করে থাকতে হয়। একটা সময়, ছেলেরা খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছেন। কাউকে এক বেলা খাওয়া দিতে পারলে তাঁকে অন্য বেলা খেতে দিতে পারেননি। জামা-কাপড়, বই-খাতা-কলম ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতেন। এ নিয়ে কখনো অভিযোগ-অভিমান করেননি। সব সময় বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন। সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতে ৩০টি বছর সংগ্রাম করেছেন।

সেজ ছেলে বজলুর চরভাগা কমিউনিটি ক্লিনিকের ইনচার্জ। তিনি বলেন, ‘তাঁদের শিক্ষিত করার জন্য মায়ের যে ত্যাগ, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না। তিনি দিনরাত পরিশ্রম করতেন। একটি শাড়ি দিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন। নিজে না খেয়ে টাকা বাঁচিয়ে আমাদের পড়ালেখার খরচ দিয়েছেন। পৃথিবীতে এমন মা কয়জনার হয়?’