রেলস্টেশনে ভবঘুরেদের আড্ডা, বিব্রত যাত্রীরা

রেলওয়ের প্ল্যাটফর্মে ভবঘুরেরা। সাম্প্রতিক ছবি।  প্রথম আলো
রেলওয়ের প্ল্যাটফর্মে ভবঘুরেরা। সাম্প্রতিক ছবি। প্রথম আলো

৬ বছরের সন্তান লামিয়াকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের যাত্রীছাউনিতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন গাজীপুরের টঙ্গী নদীবন্দর এলাকার খাদিজা বেগম। মিনিট দুয়েক পর তাঁর পাশেই প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে আড্ডায় বসে ৫-৬ জন। কারও মাথায় কোঁকড়া চুল, কারও পরনে নোংরা কাপড়, কেউ ধূমপান করছে। খাদিজা সেখান থেকে উঠে গেলেন যাত্রীছাউনির শেষ মাথার একটি দোকানের সামনে। সেখানেও ৩-৪ জনের আড্ডা। তারা ধূমপান করছে, পরস্পর গালাগাল করছে। সেখান থেকেও সরে যান খাদিজা।

এ ঘটনা ৬ মে বেলা ১১টার, গাজীপুরের টঙ্গী রেলস্টেশনে। শুধু খাদিজা নন, প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীকে একই রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। স্টেশনজুড়ে ভবঘুরেদের আড্ডা, প্রকাশ্যে মাদক সেবনসহ ছিনতাইকারীদের আতঙ্কে থাকেন যাত্রীরা। যাত্রীদের অভিযোগ, স্টেশনটিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। যত্রতত্র বহিরাগতরা ঘোরাফেরা করে। প্রকাশ্যে মাদক সেবনসহ নানাভাবে তারা যাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে। তা ছাড়া নারীদের জন্য একটি বিশ্রামাগার আছে, সেটিও অন্যদের দখলে। যাত্রীদের প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।

স্থানীয় লোকজন জানান, স্টেশনটির চারপাশ খোলা। কোথাও কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। এই সুযোগে স্টেশনজুড়ে জমে মাদকসেবীদের আড্ডা। প্ল্যাটফর্মের ভেতরে ও বাইরে প্রকাশ্যে চলে মাদক সেবন। তা ছাড়া স্টেশনে যাত্রীদের বিভিন্ন সময় হয়রানি করাসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এই ভবঘুরেরা। ছয় মাস ধরে স্টেশন এলাকায় থাকছেন আমজাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, যাত্রী ছাড়া যারা স্টেশনে ঘোরাফেরা করে তারা নানা কৌশলে ট্রেনে ওঠার ধান্দায় থাকে। কোনোমতে ট্রেনে উঠতে পারলেই ভিড়ের মধ্যে যাত্রীদের পকেট মারে। তা ছাড়া নেশা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে।

ওই দিন সকালে দেখা যায়, স্টেশনটিতে দুটি প্ল্যাটফর্ম। এর মধ্যে পূর্ব পাশের প্ল্যাটফর্মটিতে যাত্রীছাউনির মাঝবরাবর আছে কয়েকটি অবৈধ দোকান। প্রতিটি দোকানে পাঁচ থেকে ছয়জনের জটলা। কেউ চা-পান খাচ্ছে, কেউ ধূমপান করছে, আবার কেউ চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। আবার নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মেঝেতে শুয়ে আছে কয়েকজন। কেউ কেউ শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে যাত্রীরা নিজেরাই জায়গা পরিবর্তন করেন।

পশ্চিম পাশের প্ল্যাটফর্মটিতে আছে স্টেশনমাস্টারের কক্ষ, নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও নিরাপত্তাকর্মীদের কক্ষসহ অন্যান্য কক্ষ। এর মধ্যে নারী যাত্রীদের জন্য রয়েছে একটি বিশ্রামাগার। এদিন দুপুরে দেখা গেল, বিশ্রামাগারটিতে চলছে ১০-১২ জনের আড্ডা। ভেতরে শোয়ার জন্য পাতা হয়েছে বিছানা। দেয়ালের বিভিন্ন অংশে ঝোলানো আছে কাপড়চোপড়।

এক-দেড় মাস আগে রাজধানীর তেজগাঁও থেকে বাসায় ফিরছিলেন টঙ্গীর দত্তপাড়া এলাকার বাসিন্দা লতিফা বেগম। জয়দেবপুরগামী একটি কমিউটার ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার আগমুহূর্তে পেছন থেকে দুজন এসে তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা মুঠোফোন ও ৩ হাজার টাকা নিয়ে যায়। লতিফা বেগম বলেন, ‘চোখের পলকে ব্যাগের সাইড পকেটের চেইন খুলে মোবাইল ও টাকা নিয়ে দৌড় দিছে। আশপাশে এমন কাউকে পাইনি যে আমার মোবাইল ও টাকাটা উদ্ধার করে দেবে।’

টঙ্গী রেলস্টেশন সূত্রে জানা যায়, পুরো স্টেশনের আয়তন প্রায় ১০ একর। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৩০টি ট্রেন থামে এখানে। কিন্তু বিশাল এই স্টেশনের কোথাও নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য রেলওয়ের নিজস্ব ৯ জন ও রেলওয়ে পুলিশের ১৩ জন সদস্য আছেন। অবশ্য সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুরো স্টেশন ঘুরে রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সদস্য ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে টঙ্গী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, স্টেশনে মাদক সেবনকারীদের কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। এসবের বিরুদ্ধে সব সময় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

জানতে চাইলে টঙ্গী রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার হালিমুজ্জামান বলেন, নতুন করে রেলের যে কাজ শুরু হয়েছে, তাতে পুরো স্টেশনটিকে শিগগিরই নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনা হবে।