ডিবি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক নারীর অভিযোগ

নাজনাদের উত্তরার বাসায় ৭ মার্চ রাতে ডিবির উপপরিদর্শক মামুন চুক্তিপত্রটি হস্তগত করছেন। ছবি সংগৃহীত
নাজনাদের উত্তরার বাসায় ৭ মার্চ রাতে ডিবির উপপরিদর্শক মামুন চুক্তিপত্রটি হস্তগত করছেন। ছবি সংগৃহীত

সবে বাসায় ফিরেছেন জহুরুল ইসলাম। স্ত্রী নাজনা রান্নাঘরে, কোলে আড়াই বছরের ছেলে। পাশে ১১ বছরের মেয়েটি। হঠাৎ ডিবি পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ ৮ থেকে ১০ জন লোক বাসার ভেতরে ঢুকে জহুরুলকে পেটাতে শুরু করেন। মায়ের কোল থেকে শিশুসন্তানটিকে কেড়ে নিয়ে বিছানায় ওপর ফেলেন। এরপর স্বামী-স্ত্রী দুজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে।

আদালতে দাখিল করা কাগজপত্রে এই বিবরণ দিয়েছেন ভুক্তভোগী নারী। তিনি বলেন, এ ঘটনা ঘটেছে গত ৭ মার্চ উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে জহুরুল ইসলামের বাসায়। একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাজ্জাদুল করিমের সঙ্গে টাকাপয়সার লেনদেন ছিল জহুরুলের। সেই কর্মকর্তার হয়ে ডিবির পূর্ব বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার সিকদার হাসান ইমামের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়। পরে ডিবি অফিসে দুদিন আটকে রাখার পর উত্তরা পূর্ব থানায় সাজ্জাদুল করিমের দায়ের করা একটি মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এখন তাঁরা জামিনে আছেন।

নাজনা এ ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কমপ্লেইন সেলে অভিযোগ করেছেন। তাঁকে গতকাল মঙ্গলবার সেখান থেকে ফোন করা হয়েছে। বলা হয়েছে সাক্ষীসহ সদর দপ্তরে হাজির হতে।

ঘটনাস্থলটি ডিবি উত্তরের আওতাধীন, তাহলে ডিবি পূর্ব বিভাগের কর্মকর্তা সেখানে অভিযান চালালেন কেন? আর সাজ্জাদুল করিমের সঙ্গে ডিবি কর্মকর্তার সম্পর্কই–বা কী? জানতে চাইলে সাজ্জাদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সঙ্গে সিকদার হাসান ইমামের পরিচয় ছিল না। তিনি মিন্টো রোডে ডিবি অফিসের অভ্যর্থনাকক্ষে গিয়ে তাঁর সমস্যার কথা জানান। শুনে ডিবি পূর্ব বিভাগের উপপরিদর্শক তাঁকে তাঁর কাছে নিয়ে যান। এরপরে ডিবি নাজনার ব্যাপারে খোঁজখবর করে।

সম্প্রতি নাজনা ও তাঁর পরিবারের লোকজন প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে নাজনার কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা ধার নেন সাজ্জাদুল করিম। এক বছর পর সেই টাকা এককালীন ফেরত দেওয়ার কথা। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সাজ্জাদুল এক দিনে ৪টি চেকে ২০ লাখ টাকা ফেরত দেন তাঁদের। এরপর ঘোরাতে শুরু করেন। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে নাজনা আদালতে মামলা করেন।

নাজনা জানান, পৌনে ১০টার দিকে তাঁর স্বামী জহুরুল বাসায় ফেরেন। এ সময় হঠাৎ ডিবি পরিচয়ে ৮ থেকে ১০ জন লোক তাঁদের বাসায় ঢুকে পড়েন। নাজনা তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলে একজন নিজেকে ডিবি কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার সিকদার হাসান ইমাম বলে পরিচয় দেন। নাজনা তাঁদের বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁদের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল না। কারও কারও পরনে ছিল লুঙ্গি। তাঁরা নাজনার স্বামীকে বেধড়ক পেটান। তিনি ডাকাত ডাকাত বলেও চিৎকার করেন। তাঁর কোল থেকে আড়াই বছরের ছেলেকে বিছানায় ফেলেন এক ডিবি কর্মকর্তা।

ডিবি অফিসে আনার পর একজন পুলিশ কর্মকর্তা এই দম্পতিকে বলেন, সাজ্জাদুল করিমের সঙ্গে তাঁদের লেনদেনের যে চুক্তিটি আছে, সেটা দিয়ে দিতে হবে। ওই রাতেই ১২টার দিকে ডিবির পরিদর্শক মামুনুর রশিদ চুক্তিপত্র নিতে নাজনা ও জহুরুলের বাসায় যান। ডিবি অফিস থেকে নাজনা তাঁর বোনকে চুক্তিপত্র কোথায় আছে বুঝিয়ে দেন। সবার অগোচরে দূর থেকে তাঁদের এক আত্মীয় এ সময় কিছু ছবি তোলেন।

নাজনা বলেন, চুক্তিপত্র হাতে পাওয়ার পর তিনি তাঁদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। জবাবে সিকদার হাসান ইমাম বলেন, তাঁরা কষ্ট করে নিয়ে এসেছেন, মামলা একটা দিয়ে বিদায় করবেন।

গত ৮ মার্চ সাজ্জাদুল করিম উত্তরা পূর্ব থানায় নাজনা ও তাঁর স্বামী জহুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই মামলায় সাজ্জাদুল অভিযোগ করেন, ১৫ জানুয়ারি তিনি উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের সামনে ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে একজন নারী ছিলেন। ওই সময় নাজনা তাঁকে বাসায় চা খেতে ডাকেন। গল্পগুজবের একপর্যায়ে ‘ডিবি’ পরিচয়ে ছয়-সাতজন লোক একটি কক্ষে আটকিয়ে তাঁর ও তাঁর সঙ্গীর অশ্লীল ছবি তোলেন এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এরপর তিনি চাপে পড়ে ২০ লাখ টাকা দিয়ে দেন। তাঁকে জোর করে ৬০ লাখ টাকার একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয় বলেও অভিযোগ করা হয়।

মামলার এজাহার নিয়ে উত্তরা পূর্ব থানার পুলিশ আদালতে তিন দিনের রিমান্ড চায়। যুক্তিতর্ক শুনে আদালত রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন। পরবর্তী শুনানির দিনে জামিন হয়ে যায় তাঁদের। কারাগার থেকে বের হওয়ার পরও ডিবি কর্মকর্তা সিকদার হাসান ইমাম তাঁদের হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা।

যে নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সেই নম্বরে ফোন করে সিকদার হাসান ইমামকেই পাওয়া যায়। ১ এপ্রিল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাজ্জাদুল করিমের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অভিযানে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি তিনি নিয়েছেন। তিনি আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি বলেও দাবি করেন।

ডিবি কার্যালয় থেকে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা গেছে, সিকদার হাসান ইমাম ৭ মার্চ নাজনা ও তাঁর স্বামীকে তুলে আনলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মৌখিক অনুমতি নিয়েছেন দুদিন পর, অর্থাৎ ৯ মার্চ।