এখনো দুটির বেশি সন্তান, হেলায় যুব ও প্রবীণেরা

বাংলাদেশ জনসংখ্যা কমানোয় সাফল্য অর্জন করেছিল মূলত মোট প্রজনন হার কমিয়ে। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা সেবার দুর্বলতায় গত সাত বছর সেই হার এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে যুব জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে, দীর্ঘজীবী প্রবীণেরাও সংখ্যায় বাড়ছেন।

সরকারের জন্য জনসংখ্যা খাতের চ্যালেঞ্জ সুতরাং ত্রিমুখী। প্রথমত, মানসম্মত সেবা বাড়িয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম রাখা। সে জন্য বাল্যবিবাহ ঠেকানো এবং বাল্যবিবাহিত মেয়েদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, যুব জনগোষ্ঠী বেশি থাকার সবটুকু সুফল নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দেখভালের ব্যবস্থা করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সক্ষম দম্পতিরা মানসম্পন্ন পরিবার পরিকল্পনা সেবা পাচ্ছেন না। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বাড়ছে না, বিশেষত অল্প বয়সে বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে।

অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলছেন, দেশে যুব জনগোষ্ঠী এখন অনেক বড়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য এঁদের উপযুক্ত কাজে লাগাতে হবে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আতিকুর রহমানের মতে, ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রজনন হার থমকে আছে
দেশের স্বাধীনতার সময় মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিট রেট বা টিএফআর) ছিল ৬ দশমিক ৩। অর্থাৎ ১৫-৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কারণে মূলত ১৯৮০ থেকে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকজুড়ে টিএফআর কমতে থাকে।

কিন্তু বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে সর্বশেষ ২০১৭ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ হয়ে আছে। অর্থাৎ প্রজননক্ষম নারীরা দুটির বেশি সন্তান জন্ম দিয়ে চলেছেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান অবশ্য মনে করেন, টিএফআর কমানোর ক্ষেত্রে পৃথিবীর বহু দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অর্জন বেশি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যায় না পড়ে, সে ব্যাপারে সরকার সচেতন।’ সরকার কর্মসূচির দুর্বলতা দূর করতে চেষ্টা করছে।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি মানুষ নতুন করে জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০১৯ সালের বৈশ্বিক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটির কাছাকাছি। গত ৫০ বছরে দেশে সাড়ে ১০ কোটি মানুষ বেড়েছে।

সংস্থাটির আরেক হিসাবে, নগররাষ্ট্রগুলো বাদে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ১ হাজার ১৫ জনের বেশি মানুষের বাস।

সেবার মান কমছে
মাঠপর্যায়ে পরিবারকল্যাণ সহকারীরা (এফডব্লিউভি) সর্বকনিষ্ঠ কর্মী। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেন। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে এফডব্লিউভির পদ আছে ২৩ হাজার ৫০০। পাঁচ হাজার খালি পড়ে আছে।

ওয়ার্ডপর্যায়ে এফডব্লিউভিদের কাজ তদারকি করেন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক। এর ওপরের স্তরে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে সেবা দেন পরিবারকল্যাণ পরিদর্শকা। পরবর্তী স্তরে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করেন পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও চিকিৎসা কর্মকর্তা।

ঢাকা ও গাজীপুর জেলা ছাড়া ৬২টি জেলায় ও ১০টি উপজেলায় আরও আছে মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র। রাজধানীর আজিমপুর ও মোহাম্মদপুরে পরিবার পরিকল্পনা ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবার দুটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোর কাজ তদারক করেন জেলাপর্যায়ে উপপরিচালক ও বিভাগীয় পর্যায়ে পরিচালক। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কেন্দ্রীয়ভাবে দেশজোড়া কাজের দেখভাল করে।

অধিদপ্তরের জনবলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ পদ খালি। মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিনই পদ শূন্য হচ্ছে। এত শূন্য পদ রেখে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া সম্ভব না।’

শহরাঞ্চলে সরকারি মাঠকর্মী বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেন না। তবে সরকারের একটি প্রকল্পের আওতায় অনেক এনজিও নগরবাসীদের পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়। বস্তিতে এগুলোর কর্মীরা বাড়ি বাড়িও যান।

কাজী মোস্তফা সারোয়ার আরও বলেন, অধিদপ্তর শূন্য পদে নিয়োগ এবং কাজভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। শহর এলাকায় সেবা দিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। বিভাগ ও জেলাপর্যায়ে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।

তবে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের ২০১৭ সালের জরিপ দেখেছে, ৭৮ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চাহিদামতো সেবা পাওয়া যায় না। অনেক কেন্দ্রেই দক্ষ সেবাকর্মী, আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র বা নির্দেশিকা থাকে না।

ওই জরিপ অনুযায়ী জেলা ও উপজেলারএক-তৃতীয়াংশ সরকারি হাসপাতালগুলো এবং তিন-চতুর্থাংশ বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতাল দম্পতিদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি জোগায় না। বন্ধ্যাকরণ করার জায়গা খুব কম। ৮০ শতাংশ নতুন দম্পতির কাছে মাঠকর্মী যান না। মাঠকর্মীর সংকট প্রকট।

গ্রামে বা শহরে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ বাধা হচ্ছে বাল্যবিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্ব। সর্বশেষ বিডিএইচএসের (২০১৭) তথ্য উদ্ধৃত করে জনসংখ্যাবিদ অধ্যাপক মাইনুল বলেছেন, অনূর্ধ্ব-১৮ বছর বয়সী মেয়েদের ৬০ শতাংশের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের অর্ধেক মাত্র জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে। গর্ভধারণ ও মাতৃমৃত্যুর হারও তাদের মধ্যে বেশি।

সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে
টিএফআর কমে যাওয়া এবং গড় আয়ু বাড়ার ফলে দেশের জনসংখ্যার বয়সকাঠামো বদলে গেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী। সরকারি-বেসরকারি অবসরগ্রহণের বয়সের নিরিখে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষকে কর্মক্ষম ধরা যায়। দেশের ২৭ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ বছরের নিচে। আর ৮ শতাংশ হচ্ছে ষাটোর্ধ্ব বয়সী। শেষের দুই গোষ্ঠী মিলে জনসংখ্যায় নির্ভরশীল মানুষের ভাগ এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি হচ্ছে।

জনসংখ্যাবিদ ও অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, এটা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ। তবে এটাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হচ্ছে না।

জাতীয় জনসংখ্যানীতি বলছে, জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করার কাজে ২৫টি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে। জনসংখ্যানীতির বাস্তবায়ন তদারকি করে জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ। গত ৯ বছরে পরিষদের কোনো সভা হয়নি। অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম বলছেন, সভাটি হওয়া জরুরি।

যুব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৫-২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। সংখ্যায় এরা প্রায় ৫ কোটি। এই বয়সীদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে। ২০১৭ সালে এই বেকারত্বের হার ছিল ১১ শতাংশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এমন বয়সকাঠামো এমনিতেই লাভজনক। তবে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগালে লাভ অনেক বেশি হতো। যুবকদের বড় অংশ উপযুক্ত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ পায় না। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, নব্বইয়ের দশক থেকে নারীদের শ্রমবাজারে ঢোকা দ্রুত বেড়েছিল। কিন্তু তাদের জন্য উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। সামনে সেবা খাত, তথ্যপ্রযুক্তি, যন্ত্র সংযোজন খাতের প্রসার হবে। যুব জনগোষ্ঠীকে সেসবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

প্রবীণদের দেখার কেউ নেই
আজ থেকে ৫০ বছর আগে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৮ বছর। ১৯৯৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৬১ বছর। আর এখন সেটা ৭৩ বছর।

অবসরের বয়সের বিবেচনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের প্রবীণ বলা হয়। এই বয়সী মানুষেরা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ বা সংখ্যায় প্রায় দেড় কোটি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের প্রক্ষেপণ বলছে, ২০২৫ সালে ২ কোটি ছুঁয়ে ২০৫০ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে সাড়ে ৪ কোটি। মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ।

একাধিক গবেষণা বলছে, দেশে রোগের প্রকোপের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এখন দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যুর কারণ ক্যানসার, হৃদ্রোগ, কিডনির জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা শ্বাসতন্ত্রের মতো অসংক্রামক রোগ। এসব দীর্ঘস্থায়ী খরুচে রোগ প্রবীণদের মধ্যে বেশি হয়।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নুরুল কবিরের মতে, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে সরকার সচেতন ও আন্তরিক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বয়স্কভাতা কর্মসূচির আওতায় ৪০ লাখ প্রবীণ-প্রবীণা ভাতা পান। এ ছাড়া সরকার প্রবীণ নীতিমালা করেছে, পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন করেছে এবং প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। ছয়টি বিভাগে প্রবীণদের থাকার জন্য ‘শান্তি নিবাস’ আছে।

তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও জনসংখ্যাবিদেরা বলছেন, প্রবীণদের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তিন ধরনের। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য জটিলতা বাড়তে থাকে, আয়-উপার্জন থাকে না বা কমে যায়। রোগাক্রান্ত অন্যের ওপর নির্ভরশীল এসব মানুষেরা সবাই পরিবার থেকে সেবা পান না। তাঁদের একটি অংশ, বিশেষ করে নারীরা, বিনা চিকিৎসায় অর্থাভাবে অবহেলায় শেষ জীবন পার করেন।

অধ্যাপক আতিকুর রহমান প্রবীণদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রবীণ মানুষের বিশেষায়িত সেবার প্রয়োজন। তাঁদের জন্য চিকিৎসক, নার্সসহ সেবাদাতা আর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাঁদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আর সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা ও বরাদ্দ জরুরি।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, যুবপ্রধান বয়স কাঠামোর সুযোগ আরও কিছু দিন পাওয়া যাবে। এরপর মোট জনসংখ্যায় প্রবীণদের হার বাড়তে থাকবে। সুতরাং জনসংখ্যা বাড়ার হার কমানো এবং যুব জনগোষ্ঠীর পরিপূর্ণ বিকাশের পাশাপাশি প্রবীণদের জন্য বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা কোনো অংশে কম জরুরি নয়।