ঐতিহ্য হারাচ্ছে নৈশ মৎস্য আড়ত

ঢাকা থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে এসেছেন আজাদ রহমান। ভৈরবের নৈশ মৎস্য আড়তে যখন ঢুকলেন, তখন রাত সোয়া ১১টা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছিলেন। কিছুক্ষণ পর টুকরি হাতে এক কিশোরকে দেখতে পেয়ে কাছে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, এটা ভৈরবের রাতের মাছের আড়ত কি না। ‘হ্যাঁ’-সূচক উত্তর পেয়ে তিনি যেন আরও বিস্মিত। এটাই যদি মাছের আড়ত হবে, তাহলে মাছ কোথায়? ক্রেতা-বিক্রেতা নেই কেন?

সর্বশেষ ছয় বছর আগে এক গভীর রাতে এই আড়তে এসেছিলেন আজাদ রহমান। তখন মাছ আর ক্রেতা-বিক্রেতার সরগরমে তাঁর পক্ষে দামদর করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আর ১০ মে এসে মাছ না পেয়ে শেষে তাঁকে না কিনেই ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। আজাদ রহমান ঢাকার একটি সরকারি দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অঘোষিতভাবে দেশের সর্ববৃহৎ মাছের আড়তের খেতাব পাওয়া ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়তে এখন মাছ ওঠা মাত্রাতিরিক্ত হারে কমে গেছে। নামে রাতের আড়ত হলেও মাছ না থাকায় এখন সন্ধ্যার মধ্যেই কেনাবেচা গুটিয়ে ঘরমুখো হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

দুলাল মিয়া ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আড়তের ভালোমন্দ দেখার একমাত্র স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ এই সংগঠন। দুলাল বলেন, চার বছর আগেও এই আড়তে প্রতি রাতে গড়ে সাত কোটি টাকার মাছ বিক্রি হতো। মাসে কেনাবেচার পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি টাকা। এখন দৈনিক বিক্রি নেমে এসেছে সর্বোচ্চ অর্ধকোটি টাকায়। দুলালের আশঙ্কা, প্রতিবছর যে হারে মাছের আমদানি ও বিক্রি কমছে, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আড়তটি পুরোপুরি বন্ধ হতে দুই এক বছরের বেশি সময় লাগার কথা নয়।

ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়তের যাত্রা ২৫ বছর আগে। অবস্থান মেঘনা নদীর ভৈরব মোহনার পুরোনো ফেরিঘাট এলাকায়। আড়তে বর্তমান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সংখ্যা ১৮৬টি। আড়তকে কেন্দ্র করে অন্তত ২০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত। এই আড়তের বিশেষত্ব বিস্তীর্ণ হাওরের মিঠাপানির মাছ। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা, নিকলী, হবিগঞ্জের লাখাই, সাল্লা, দিরাই, আজমিরীগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওরের আহরিত মাছের বেশির ভাগ ট্রলারযোগে আড়তে এনে বাজারজাত করা হয়। আইড়, বোয়াল, বাইম, তারা বাইম, রুই, কাতলা, চিংড়ি, পাবদা, আলনি, মলা, ঢ্যালা, কাজলি, গুলশা, বেলে, টেংরা, শোল, গজার, কালবাউশ, শিং, কই, মাগুর, পুঁটি, বইছা, চান্দা, কাঁচকি মাছের জন্য বিশেষ সুনাম রয়েছে ভৈরবের এই আড়তের। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে রাত দুইটা পর্যন্ত কেনাবেচা হতো। হিসাবের খাতা গোটাতে গোটাতে ভোর হয়ে যেত। এই আড়তের ৮০ ভাগ মাছ ঢাকার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ হয়ে থাকে। এ ছাড়া গাজীপুর ও চট্টগ্রামেও যায়। কিছু অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও কাতার এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে।

১০ মে রাত ১১টার দিকে আড়তে গিয়ে দেখা গেছে, পিনপতন নীরবতা। নেই ক্রেতা-বিক্রেতার ছিটেফোঁটা। আড়তের সব কটি ঘরের আলো নেভানো। আড়তজুড়ে অন্ধকার নেমে ছিল। ১৮৬টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে খোলা ছিল মাত্র চারটি। সেগুলোতেও বেচাকেনা ছিল না। ঘরে বসে ক্রিকেট খেলা দেখছিলেন কর্মরত ব্যক্তিরা।

ব্যবসায়ীরা জানালেন, তিন বছর আগে থেকে এই আড়তে মাছ আসা কমতে শুরু করে। বর্তমানে হাওরের মাছ নেই বললেই চলে। আড়তের দুরবস্থার কারণ জানতে গিয়ে জানা গেল, আহরিত মাছের বেশির ভাগ এখন বিকল্প পথে সরাসরি ঢাকায় সরবরাহ হচ্ছে। ভৈরব আড়ত থেকে হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টের নদীপথে দূরত্ব গড়ে তিন ঘণ্টা হওয়ায় পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। মেঘনায় নৌ-পুলিশের টহল সন্ধ্যার পর গুটিয়ে নেওয়ায় রাতে ডাকাতের উৎপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাওরে পানি কম হওয়া, খাল-বিল ভরাট এবং খাল-বিলের সঙ্গে মেঘনার বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হওয়া, পোনা ও মা মাছ নিধনে সরকারি বাধা না থাকা, মেঘনায় পোনা অবমুক্ত না করা—এসব কারণে হাওরে মাছ কমে যাচ্ছে।

অষ্টগ্রাম হাওর থেকে এক যুগ ধরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন ওই এলাকার জেলে বিনয় বর্মণ। তিনি বলেন, ‘গাঙে পানি নাই। ভরা বর্ষায়ও গাঙ ভরে না। খাল-বিল তো নাই-ই। মাছ কি আর জমিতে হইব?’