আমের রাজধানীতে আশা-নিরাশার দোলাচল

মাত্র আর কয়েকটি দিন বাকি। আমের রাজ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিকে চাঙা করতে আসছে ফলের রাজা আম। তবে চিন্তিত আমচাষি ও আম ব্যবসায়ীরা। আশা-নিরাশার দোলাচলে রয়েছেন তাঁরা। কেননা টানা তিন বছর ধরে চলছে আমের দরপতন। অনেকেই পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। ‘এবার না–জানি কপালে কী আছে’—এমন দুশ্চিন্তা তাড়া করে ফিরছে তাঁদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের বড় মোকাম হচ্ছে শিবগঞ্জ। জেলার ৩১ হাজার ৮২০ হেক্টর বাগানের মধ্যে শিবগঞ্জে রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর। এখানকার আমচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার অনেক চাষিই আমের পরিচর্যায় কোনো ধরনের বিনিয়োগ করেননি। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার ফলনও কম।

শিবগঞ্জ আম আড়তদার সমিতির সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, কয়েক দিন পরেই বাজারে আম আসতে শুরু করবে। তবে তাঁদের মধ্যে তেমন কোনো উৎসাহ–উদ্দীপনা নেই। কেননা শিবগঞ্জের আড়তদারদের মধ্যে অনেকে নিজেরাই আমচাষি। কয়েক বছর আমের দরপতনের কারণে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বছর কী হয়, তা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত।

শিবগঞ্জ পৌর এলাকার সেলিমাবাদ মহল্লার য়ামত খান, আবদুস সবুর ও জেকিদাদ খান বলেন, গত বছর লাভ তো দূরের কথা, বিনিয়োগই ওঠেনি। এ জন্য তাঁরা এবার কোনো বিনিয়োগ করেননি। কেননা বালাইনাশকের দোকানে গত বছরের দেনা এখনো পর্যন্ত তাঁরা পরিশোধ করতে পারেননি। তাঁদের এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় শিবগঞ্জ বালাইনাশক বিক্রেতা সমিতির সভাপতি ইউসুফ আলীর সঙ্গে কথা বলে। ইউসুফ আলী বলেন, এবার বালাইনাশকের বিক্রি গতবারের তুলনায় অর্ধেকের কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বাকিতে বালাইনাশক নিয়ে যান এবং আম বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু গত মৌসুমে ৩ ভাগের ১ ভাগও তাঁরা পরিশোধ করতে পারেননি। এ জন্য এখনো পর্যন্ত বাকির অর্থ পরিশোধ করতে না–পারা চাষি ও ব্যবসায়ীরা এবার পরিচর্যার জন্য বালাইনাশক নিতে আসেননি। তিনি বলেন, শুধু শিবগঞ্জেই বালাইনাশকের ব্যবসা হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো। আম ব্যবসায় শনির দশা চলছে। এবার যদি আমের দাম না পাওয়া যায়, তবে অনেক আমচাষিই তাঁদের বাগানের আমগাছ কেটে ফেলা শুরু করবেন। এভাবে চলতে থাকলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ তার আমের ঐতিহ্য হারাবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

ভোলাহাট উপজেলার ‘ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশন’-এর সাধারণ সম্পাদক মো. চুটু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, শিবগঞ্জের মতো অবস্থা ভোলাহাটেরও। আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা ও আশঙ্কা বিরাজ করছে।

তবে ‘শিবগঞ্জ ম্যাঙ্গো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’-এর সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান গত বছর ক্ষতির শিকার হলেও এবার একাধিক আমবাগানে কৃষিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচর্যা অব্যাহত রেখেছেন। ইসমাইল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরপর তিন বছর আমের দরপতনের কারণে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা। আমের পরিচর্যাও ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই এবার প্রয়োজন অনুযায়ী পরিচর্যা করতে পারেননি। তবে তিনি পরিচর্যা করায় ফলন ভালো হয়েছে। তবে তিনিও আশা–নিরাশার দোলাচলে। তিনি বলেন, রপ্তানির সুযোগ পাওয়া না গেলে বাজারে আমের দাম উঠবে না। অন্যান্য বছর এই সময়ের মধ্যে আমবাগানগুলোর ফল কয়েক হাত বদল হলেও এবার বাগানের দামই বলছেন না ব্যবসায়ীরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের অতিরিক্ত উপপরিচালক ইয়াছিন আলী বলেন, গত বছর আমের উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এবার আমচাষিরা পরিচর্যা কিছুটা কম করেছেন। তাই এবার ফলন কিছুটা কম হবে। এবার ৩১ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে।

এবার আম বাজারজাতকরণে কোনো সময়সীমা থাকবে না বলে রোববার জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে জানিয়েছেন সভায় উপস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনের সাংসদ হারুনুর রশীদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বরাবরই সময়মতো পরিপক্ব অবস্থায় আম বাজারজাত করা হয়। সময় নির্ধারণ করাতে আমচাষিদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এবার কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।