বাঁধ ভাঙনে আতঙ্ক, ক্ষোভ

ইসলামপুরে যমুনার ভাঙনে ধসে গেছে বাঁধের কিছু অংশ। এতে ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছে স্থানীয় ব্যক্তিরা। গতকাল সকালে মুরাদাবাদ গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
ইসলামপুরে যমুনার ভাঙনে ধসে গেছে বাঁধের কিছু অংশ। এতে ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছে স্থানীয় ব্যক্তিরা। গতকাল সকালে মুরাদাবাদ গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার পাথর্শী ইউনিয়নের মুরাদাবাদ গ্রামে ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের তিনটি স্থানে ২০০ মিটার ধসে গেছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাঁধে ধস নামলেও এখন পর্যন্ত ওই অংশ মেরামতের কাজ শুরু হয়নি। ফলে গ্রামবাসী বড় ধরনের ভাঙনের আশঙ্কা করছে।

গতকাল শনিবার সকালে যমুনা নদীর পাড় মুরাদাবাদ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, মুরাদাবাদ ঘাট থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরত্বে বাঁধের ভাঙন স্থান। বিশাল বাঁধটির তিনটি স্থানে প্রায় ২০০ মিটার ভেঙে কংক্রিটের সিসি ব্লক পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙন বাঁধের দক্ষিণ দিকে ঢুকছে। জিও ব্যাগসহ ভেঙে গিয়েছে বাঁধটি। পানির স্রোতে বাঁধ থেকে ধীরে ধীরে সিসি ব্লক সরে যাচ্ছে। ভাঙন স্থানগুলো বিশাল আকার ধারণ করছে। পানির স্রোত ভাঙন অংশে ধাক্কা দিচ্ছে। এতে বাঁধের কংক্রিটের সিসি ব্লক সরে মাটি বেরিয়ে গেছে। লোকজন দাঁড়িয়ে ভাঙন স্থান দেখছে। বাঁধের পাশেই বিশাল বালুর স্তূপ। বাঁধের মাঝখানে এখনো বালু উত্তোলনের পাইপ লাগানো রয়েছে। বাঁধের পাশেই রয়েছে বালু উত্তোলনের বিভিন্ন সরঞ্জাম।

তিন-চার মাস আগে কুলকান্দি ইউনিয়নের মিয়াপাড়া, মাঝিপাড়া ও ঈদগাহ মাঠে প্রায় ১৫০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। সেখানেও বাঁধের সিসি ব্লক সরে গেছে। ভাঙন স্থানে বালুর বস্তা ফেলা রয়েছে। তবে ভাঙনস্থান ঝুঁকিমুক্ত নয়।

স্থানীয় কয়েকজন জানান, প্রায় তিন-চার মাস আগে কুলকান্দি এলাকার তিনটি স্থান ধসে যায়। পাউবো থেকে শুধু বালুর বস্তা ফেলে রাখা হয়েছে। কয়েক মাস অতিবাহিত হলেও ভাঙন স্থানে স্থায়ী কোনো কাজ করা হয়নি। তাঁরা বলেন, বাঁধটি পশ্চিম ইসলামপুরবাসীর জন্য আশীর্বাদ ছিল। বাঁধ নির্মাণের আগে সারা বছর রাক্ষুসী যমুনার ভাঙন ছিল। বন্যায় গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হতো। গ্রামবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাঁধটি নির্মিত হয়। এরপর থেকে কয়েক বছর ভাঙনে গ্রাম প্লাবিত হয়নি। কিন্তু বাঁধটিতে এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে, এটা তাঁরা চিন্তাও করেননি। মুরাদাবাদ ঘাটে বিশাল ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণেই এত দ্রুত বাঁধে ভাঙন ধরেছে বলে তাঁরা মনে করছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জামালপুর কার্যালয় সূত্র জানায়, ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের বিস্তীর্ণ জনপদ রক্ষায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৬ সালে দেওয়ানগঞ্জের ফুটানিবাজার থেকে ইসলামপুরের কুলকান্দি গ্রাম পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধ নির্মাণে ২২০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। ২০১৬ সালের জুনে বাঁধটি নির্মাণকাজ শেষ হয়। এতে নদীভাঙন ও বন্যার হাত থেকে অনেকটাই মুক্তি পেয়েছিল গ্রামবাসী।

বাঁধের দক্ষিণ পাশের বাসিন্দা শহিদুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার বাঁধটিতে ভাঙন শুরু হয়। তাঁরা এখন খুবই আতঙ্কগ্রস্ত। বাঁধটি তাঁদের সম্পদ। বাঁধের কারণে গ্রামে ভাঙন ছিল না। একসময় নদীর মাঝখানে ছিল গ্রামটি। ভাঙতে ভাঙতে গ্রামটি এত ছোট হয়ে গেছে। কিছু প্রভাবশালী লোক টাকার লোভে ড্রেজার মেশিন দিয়ে দিনের পর দিন বালু তুলেছে। এতেই নদীর গভীরতা বেড়েছে। তাই এদিকটাতে পানির স্রোতও বেশি। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার ভাঙলেও এখনো মেরামতের কাজ শুরু হয়নি। জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করা না হলে বাঁধের আরও বড় ক্ষতি হতে পারে।

মুরাদাবাদ গ্রামের রহমত আলী বলেন, ‘২২০ কোটি টাকায় এই বাঁধ। সরকার তো ঠিকই বরাদ্দ দেয়, কিন্তু আমগোর লোকজনই ভালো না। তারা টাকা চুরি করে খায়। এত টাকার বাঁধ এত তাড়াতাড়ি ভাঙবে কেন? কাজের মধ্যে গাফিলতি ছিল। জরুরি ভিত্তিতে বাঁধটি মেরামত করা না হলে গ্রামবাসীর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।’

কুলকান্দি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপির সাবেক সদস্য মুকবুল হোসেন জানান, কুলকন্দি অংশের তিনটি স্থানে গত তিন মাস আগে বাঁধটি ধসে যায়। সে সময় কিছু বালুর বস্তা ফেলা হয়েছিল। এরপর আর কোনো কাজ হয়নি। এখনো সেভাবে আছে। সামনে বর্ষা মৌসুম। পানিতে নদী ভরে যাবে। তখন পুরো বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পাউবো জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী বলেন, ২০১৬ সালের জুনে বাঁধটির সব কাজ সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালে বিশাল বন্যাতেও বাঁধটির কোথাও কোনো ক্ষতি হয়নি। কোথাও ভাঙেওনি। তবে বৃহস্পতিবার মুরাদাবাদ ঘাটের অংশে কয়েকটি স্থানে কিছুটা ধসে গিয়েছে। ভাঙা অংশে জরুরি ভিত্তিতে মেরামতকাজ শনিবার থেকে শুরু হয়েছে।

নবকুমার চৌধুরী বলেন, যমুনা নদীর দুটি চ্যানেল দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো। কিন্তু নদীর উত্তর অংশের চ্যানেলটি বালুর চর পরে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সব পানি বাঁধের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে পানির স্রোত সরাসরি বাঁধে আঘাত হানছে। তারপর এই ঘাটে দীর্ঘদিন বাঁধের কাছ থেকে বালু উত্তোলন করা হয়েছে। অনেক নিষেধ করার পরও তারা শোনেনি। এসব কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে কিছু ধস নেমেছে। তবে নতুন ও কুলকান্দি ইউনিয়নের ভাঙা অংশ স্থায়ীভাবে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।