দুদক না ডিআইজি কে বেশি দায়ী?

মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাসির
মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাসির

ঘুষ নিয়েছেন দুদক পরিচালক, আর ঘুষ দিয়েছেন পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি)। তাহলে কে বেশি দায়ী—এ নিয়েই কাল দিনভর আলোচনা ছিল। দিন শেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশ—দুই তরফেই বলা হয়েছে, খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তথ্য পাচার, চাকরির শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অসদাচরণের অভিযোগে দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসিরকে গতকাল বিকেলে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এই আলোচনার সূত্রপাত মূলত রোববার থেকে। দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসিরের বিরুদ্ধে পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, মামলা থেকে অব্যাহতি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে দুদক পরিচালক তাঁর কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। দ্বিতীয় বিয়ে গোপন করতে নারী নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে ডিআইজি মিজানুরকে গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছিল। দুদক পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগের খবরটি এটিএন নিউজে প্রচারের পরপরই দুদক তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে।

গতকাল বিকেলে অফিস শেষে বেরোনোর সময় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। এনামুল ঘুষ নিয়েছেন কি না, সে বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। ঘুষ লেনদেনে অডিও রেকর্ডের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, দুদকের ৮৭৪ জন কর্মীর সততার নিশ্চয়তা কমিশন দিতে পারে না। তবে এনামুল বাসিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। আর মিজানুর রহমানের বিষয়ে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চলা তদন্ত থেকে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। দুদক পরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠল, এতে কমিশন বিব্রত কি না—এ প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, কমিশন বিব্রত নয়। ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না। খুনের দায়ে সাজা হয় খুনির, খুনির বাবার নয়। চেয়ারম্যান দায় এড়াতে চাইছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দায় এড়াতে চান না বলেই ব্যবস্থা নিয়েছেন। তবে ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুদক মামলা করবে।

মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামলা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। তিনি চান, ওই ৪০ লাখ টাকা কী করে তিনি জোগাড় করেছেন, কমিশন যেন তা খতিয়ে দেখে। ঘুষ দেওয়াও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ, এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থান কী—জবাবে তিনি বলেন, ‘এর আগে দুদকের যে কর্মকর্তা প্রাথমিক তদন্ত করছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই পরিচালকও টাকা নিলেন। প্রশ্ন হলো, দুদক কি দুর্নীতিবাজদের আখড়া হয়ে গেল। আর আমি তো দুদক পরিচালককে ট্র্যাপ করতে চেয়েছিলাম। ওটা ছিল আমার কৌশল। আমি তো ঘুষ দিতে চাইনি।’

>

ঘুষ নিয়েছেন দুদক পরিচালক
ঘুষ দিয়েছেন পুলিশের ডিআইজি
ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে মামলা হবে
ঘুষ গ্রহণকারী বরখাস্ত, ঘুষদাতা বহাল

মিজানুর যে মুঠোফোন নম্বরে এনামুলের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেটি কখন, কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ফোনের সিম তাঁর গাড়িচালকের নামে তোলা হলেও সেটি ব্যবহৃত হয়েছে দুদক কার্যালয়, রমনা পার্ক (যেখানে টাকা লেনদেন হয়েছে) এবং এনামুল বাসিরের বাসায়। খুব সহজেই মুঠোফোনের কণ্ঠস্বরটি এনামুলের কি না, তা–ও বের করা সম্ভব।

মিজানুর রহমান প্রকাশ্যে ঘুষ দেওয়ার কথা বলছেন, বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তর কীভাবে দেখছে, জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরের দৃষ্টিতে এসেছে। খতিয়ে দেখে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কমিটির কার্যক্রম
রোববার দুদকের সচিব মো. দিলওয়ার বখতকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন আইন শাখার মহাপরিচালক মো. মফিজুর রহমান ভূঞা ও প্রশাসন শাখার মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান। কমিটি এনামুল বাসির, এটিএন নিউজের সাংবাদিক ইমরান এইচ সুমনসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা ইমরানের কাছ থেকে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু যিনি ঘুষ দিয়েছেন, সেই মিজানুর রহমানের সঙ্গেই কথা বলেনি দুদক। দুদকের কমিটি এনামুল বাসিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিস্তারিত খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেছে।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, এনামুল বাসির ঘুষ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, কমিটি এনামুল বাসিরকে নির্দোষ ধরে নিয়েই তদন্ত শুরু করে। এনামুল কমিটিকে বলেন, তিনি তাঁর ফোন থেকে মিজানুরের সঙ্গে কথা বলেননি। অডিও রেকর্ডটি ভুয়া। তিনি গাড়িও চাননি মিজানুরের কাছ থেকে। ছেলের যাতায়াতে অসুবিধা হয়—গল্পচ্ছলে এটুকুই বলেছেন।

এনামুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শারীরবিদ্যায় স্নাতক করেছেন। ১৯৯১ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে যোগ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন বিভাগের উপপরিচালক হিসেবেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর চাকরি আছে আর তিন বছর।