বাড়িটাও যেন পাঠশালা

স্কুল ছুটি। তাই নিজের বাসায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হোসনেয়ারা পারভীন। সম্প্রতি তোলা ছবি।  প্রথম আলো
স্কুল ছুটি। তাই নিজের বাসায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হোসনেয়ারা পারভীন। সম্প্রতি তোলা ছবি। প্রথম আলো

স্কুলে পাঠদান শুরু হয় সকাল নয়টায়। তিনি যান সকাল সাড়ে সাতটায়। আনুষ্ঠানিক পাঠাদান নির্ধারিত সময়ের আগেই তিনি শুরু করেন। আবার স্কুল টানা ছুটি থাকলে শিক্ষার্থীরা চলে যায় তাঁর বাসায়। সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বাড়িতেই পাঠদান করেন। কখনো পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার্থী আবার কখনো স্কুলের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বাছাই করে তিনি এভাবে বাড়তি পাঠদান করেন। এতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো করছে। তবে এর বিনিময়ে এই শিক্ষক কোনো অর্থ নেন না।

এই শিক্ষকের নাম হোসনেয়ারা পারভীন (৩৫)। তিনি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। দুই বছর ধরে তিনি নিয়মিত এই কাজ করে আসছেন। তাঁর বাড়ি উপজেলার মনিগ্রাম দক্ষিণপাড়া। তাঁর স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান কলেজশিক্ষক। এই দম্পতি নতুন একটি বাড়ি বানিয়েছেন। সেই বাড়ির ‘ডাইনিং স্পেস’ এত বড় করেছেন যে সেখানে হোসনেয়ারা ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থীকে অনায়াসে পাঠদান করাতে পারেন।

কয়েক দিন আগে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পাঠদান চলছে। পাশের তিন-চারটি গ্রাম থেকে শিক্ষার্থীরা এসেছে। কেউ এসেছে হেঁটে। কেউ বাইসাইকেলে। কারও অভিভাবক সঙ্গে এসেছেন। বাচ্চাকে পড়তে দিয়ে বসার ঘরে অপেক্ষা করছেন। এ রকম একজন অভিভাবক মো. নিজাম উদ্দিন। তিনি নিজেও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তারপরও নিজের বাচ্চাকে হোসনেয়ারার বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, নিজে শিক্ষক হলেও বাচ্চার শ্রেণিশিক্ষক তাকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেভাবেই তাকে যেতে দিতে হবে। তা ছাড়া তাঁর বাচ্চাকে ঈদের ছুটিতে শিক্ষক হোসনেয়ারা তাঁর বাসায় পড়ানোর জন্য মনোনীত করেছেন। এ জন্যই নিয়ে এসেছেন।

শিক্ষার্থীদের খাতা দেখতে গিয়ে একটু অবাক হওয়ার মতো একটি বিষয় চোখে পড়ল। সব শিক্ষার্থীর হাতের লেখা প্রায় একই রকম। তারা জানাল, তারা সবাই তাদের হোসনেয়ারা ম্যাডামের হাতের লেখা অনুসরণ করে। চমৎকার এই হাতের লেখা।

শিক্ষার্থী আনজিলা আক্তার জানায়, হোসনেয়ারা তাদের খুবই যত্ন নেন। তাঁর ব্যবহারও খুবই ভালো। তিনি আদর করে পড়ান। এ জন্য বাড়তি সময়ে তাঁর কাছে পড়তেও তাদের ভালো লাগে।

শাওন আলী বলে, কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে হোসনেয়ারা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কখনোই বিরক্ত হন না।Ñমুসলিমা আক্তার জানায়, ‘বিজ্ঞান আমার কাছে কঠিন লাগে। কিন্তু ম্যাডাম বুঝিয়ে দিলেই সহজ হয়ে যায়।’

হোসনেয়ারা পারভীন জানান, শ্রেণিকক্ষে বাচ্চা যতটুকু শিখছে, তার মনে হয়েছে, শিক্ষক হিসেবে তাদের আরও দেওয়ার আছে। আর তিনি সেটা দিতে পারবেন। সেই জন্যই তিনি বাড়িতে এবং স্কুলে বাড়তি পাঠদান করান। তিনি দেখছেন, এতে স্কুলের ফলাফল ভালো হচ্ছে। তিনি আশা করছেন, তাঁর এই কাজ দেখে অন্য শিক্ষকেরাও উৎসাহিত হবেন। তিনি বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও এ ব্যাপারে উৎসাহী। তিনিও বিকেলে শিক্ষার্থীদের বাড়তি পাঠদান করেন।

হোসনেয়ারার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তাঁর স্ত্রীর এই উদ্যোগ তাঁর কাছে ভালোই লাগে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, হোসনেয়ারার বাড়তি পাঠদানে বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো হচ্ছে। এবার তাদের বিদ্যালয় থেকে ১৯ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। তার মধ্যে আটজনই ট্যালেন্টপুলে। তিনি বলেন, তাঁরা পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের জন্য আলাদা ক্লাস নেন। নিয়মিত মা সমাবেশে করে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করেন। দীর্ঘদিন থেকে তাদের বিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করে। এর মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে হোসনেয়ারা এসে এই বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে ফলাফল আরও ভালো হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের সভাপতি আবদুল মোমেন বলেন, হোসনেয়ারা বিদ্যালয়ে যে অবদান রাখছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অতীতে কোনো শিক্ষক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এভাবে ত্যাগ স্বীকার করেননি।