বৃষ্টিতে ঘরে মেলতে হয় ছাতা

কাপাসিয়া উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর। সম্প্রতি তোলা ছবি।  ছবি: প্রথম আলো
কাপাসিয়া উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর। সম্প্রতি তোলা ছবি। ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের কাপাসিয়ার উরুন গ্রামের আবদুল কাদের। নিজের থাকার জায়গা ছিল না। রিকশা চালিয়ে যা পেতেন, তা দিয়ে কোনো রকম সংসার চলত তাঁর। কখনো তাঁকে থাকতে হয়েছে মানুষের বাড়ির বারান্দায়, কখনো রান্নাঘরে, কখনোবা কারও পরিত্যক্ত ঘরে।

এ অবস্থা থেকে আবদুল কাদের কিছুটা স্বস্তি পান ১৯৯৮ সালে। ঠাঁই হয় কাপাসিয়ার দেওনা গ্রামের ‘দেওনা আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের একটি ঘরে। সেখানে বিনা পয়সায় ঘর পেয়ে ভালোই ছিলেন তিনি। সংসারও হয়েছে এর মধ্যে। কিন্তু কয়েক বছর যেতেই দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। মরিচা পড়ে ঘরের চাল নষ্ট হয়ে যায়। দরজা-জানালা ভাঙাচোরা হয়ে পড়ে। বৃষ্টি হলে পানি আর গরমে অসহ্য কষ্ট করতে হয় তাঁকে। যেন সেই পুরোনো কষ্টের পুনরাবৃত্তি। আবদুল কাদের আক্ষেপ করে বলেন, ‘জীবনে আর সুখ হইল না। ভাবছিলাম যত দিন বাঁচি, এখানেই থাকমু। কিন্তু এখন উপায় নাই। বৃষ্টি হলে ঘরের ভেতর ছাতা নিয়ে বইসা থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে পানির কারণে ঘরের ভেতর নড়াচড়া করার অবস্থা থাকে না।’

আবদুল কাদের ২০০৭ সালে একবার আশ্রয়ণ প্রকল্প ছেড়ে চলে যান। পরে ঘর ভাড়া নিয়ে কিছুদিন থাকার পর আর সংসার চালাতে পারছিলেন না। আবার ঠাঁই নেন প্রকল্পের ঘরে।

আবদুল কাদেরের মতো হতদরিদ্র ৮০টি পরিবার ১৯৯৮ সালে আশ্রয় পায় কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের দেওনা গ্রামে ‘দেওনা আশ্রয়ণ প্রকল্পে’। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে সরকার ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পে মসজিদ, পুকুর, কবরস্থান, সমবায় সমিতির কার্যালয়সহ টিনের তৈরি ঘর রয়েছে ৮০টি। প্রতি ১০টি পরিবারের জন্য যৌথভাবে চারটি শৌচাগার ও দুটি গোসলখানা নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কৃষিকাজের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ৮ শতাংশ জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্মাণের পর আর দেখভাল না করা সবকিছুই বেহাল হয়ে পড়ে।

ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৪০টি পরিবার ঘর ছেড়ে চলে গেছে। অন্য বাসিন্দাদের অভিযোগ, নির্মাণের পর থেকে প্রকল্পে কোনো সংস্কার করা হয়নি। অনেক সময় ঝড়ে ঘরের চাল উড়ে গেছে, দরজা-জানালা ভেঙে গেছে, মানুষ আহত হয়েছে। কিন্তু বিষয়গুলো স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর পরও তাদের টনক নড়েনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ‘আমরা কমপক্ষে ১০ বার ইউএনও বরাবর লিখিত অনুরোধ জানাইছি। এরপরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, প্রকল্পটির প্রায় প্রতিটি ঘরই জরাজীর্ণ। টিনে মরিচা পড়েছে, জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। বিভিন্ন কক্ষের দরজা-জানালা ভেঙে পড়ে আছে। কয়েকটি ব্যারাকের চাল নেই। কিছু পরিবার জোড়াতালি দিয়ে ঘরের চাল মেরামত করলেও তা খুবই নড়বড়ে। শৌচাগার ও নলকূপের অবস্থাও খারাপ। শৌচাগারের কোনোটির দরজা নেই। কোনোটির ওপরে চাল নেই। বাসিন্দারা জানান, ৩২টি শৌচাগারের সব কটিই এখন বেহাল। কিছু পরিবার বাধ্য হয়ে গর্ত খুঁড়ে শৌচাগার তৈরি করছে। আর আটটি নলকূপের ছয়টি অকেজো হয়ে গেছে। মো. মোশারফ নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘ঘরের কষ্ট সহ্য করা গেলেও পানি ছাড়া কোনোভাবেই থাকা যায় না। তাই নিজেরাই টাকাপয়সা তুলে বাকি দুটি নলকূপ সচল রেখেছি। নয়তো এত দিন বাঁইচা থাকাই কষ্ট হইয়া যাইত।’

বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ব্যারাকের প্রায় প্রতিটি ঘরের চালের নিচে পলিথিন এবং চালের ওপর ইট দিয়ে রেখেছেন বাসিন্দারা। বৃষ্টির পানি ধরার জন্য কেউ কেউ রান্নাবান্নার পাত্র প্রস্তুত রেখেছেন। ফাতেমা বেগম বলেন, ‘এবার সবাই ঈদের দিন আনন্দ-ফুর্তি করছে। কিন্তু আমরা সকাল থেকেই ঘরের পানি সেচা নিয়া ব্যস্ত ছিলাম। বর্ষায় দুর্ভোগ আরও বাড়বে।’

যোগাযোগ করা হলে ইউএনও ইসমত আরা বলেন, ‘তাঁরা আমাকে বিষয়টি জানানো পরপরই আমি পিআইওকে (উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা) নির্দেশ দিয়েছি। তিনি সেখানে গিয়ে কার কী সমস্যা, তা শুনবেন এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করবেন। এরপর তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে তাঁরা (ভুক্তভোগী) সহযোগিতা পাবেন।’