দরপত্র বিক্রি ৪ হাজার, জমা মাত্র ২০৬টি

মাগুরা জেলায় ৪৭টি সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এসব কাজের জন্য দরপত্র বিক্রি হয়েছে ৪ হাজারের বেশি। তবে জমা পড়েছে মাত্র ২০৬টি। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বাধার কারণে ঠিকাদারেরা এসব দরপত্র জমা দিতে পারেননি। 

জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের ৪৭টি সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৮৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। দরপত্র বিক্রির শেষ সময় ছিল ২০ জুন। জমা নেওয়া হয় ২৩ জুন বেলা ১টা পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় মাগুরা সদর উপজেলায় ৪ কোটি ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৬১৮ টাকায় নির্মিত হবে ১৭টি সেতু। সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, এসব কাজের বিপরীতে শতাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ১ হাজার ৫৬০টি দরপত্র বিক্রি করা হয়। ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত কাজের প্রতিটি দরপত্রের দাম ছিল ১ হাজার টাকা। আর এর চেয়ে বেশি টাকার কাজের প্রকল্পের প্রতিটি দরপত্রের দাম ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। তবে জমা পড়েছে মাত্র ৭১টি দরপত্র।

একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে শ্রীপুর, শালিখা ও মহম্মদপুর উপজেলায়ও। শ্রীপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ১১টি সেতুর জন্য বিক্রি হয় ৮ শতাধিক দরপত্র। জমা পড়েছে ৫১টি। একইভাবে মহম্মদপুরে ১০টি প্রকল্পের জন্য দরপত্র বিক্রি হয় ৯ শতাধিক। জমা পড়েছে মাত্র ৪২টি। আর শালিখায় ৯টি প্রকল্পের বিপরীতে জমা পড়েছে মাত্র ৪২টি দরপত্র। সেখানে দরপত্র বিক্রি হয়েছিল ৮৫০টির বেশি। 

রোববার দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে একটি করে দরপত্র বাক্স রাখা হয় সংশ্লিষ্ট চার উপজেলার পিআইওর কার্যালয়ে। পাশাপাশি মাগুরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরেও একটি বাক্স রাখা হয়েছিল। তবে চার উপজেলায় পিআইওর কার্যালয়ে রাখা বাক্সে নির্ধারিত সময়ে একটি দরপত্রও জমা পড়েনি। ৪৭টি প্রকল্পের বিপরীতে জমা পড়া মোট ২০৬টি দরপত্রের সবগুলোই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বাক্সে জমা হয়।

ফরিদপুরের মধুখালীর মেসার্স রাজন ট্রেডার্সের লাইসেন্সে মাগুরা সদর উপজেলার ১৭টি দরপত্র কিনেছিলেন প্রতিষ্ঠানের মালিক ঠিকাদার শাহ ফারুক হোসেন। তবে একটি দরপত্রও জমা দিতে পারেননি তিনি। শাহ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৮৮ সাল থেকে ঠিকাদারি করি। প্রতিবছরই ত্রাণের শিডিউল (দরপত্র) কিনি। এবারও মানিকগঞ্জ, অভয়নগর, আলফাডাঙ্গা, খোকসায় কিনেছিলাম। কোথাও সমস্যা হয়নি। কিন্তু মাগুরায় জমাই দিতে পারলাম না। আগে জানালে আমরা শিডিউল কিনতাম না। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসম্মানও বেঁচে যেত।’ এই ঠিকাদার বলেন, শ্রীপুরে তাঁদের দরপত্র কিনতে দেওয়া হয়নি। ছাত্রলীগের ছেলেরা তাঁদের প্রতিনিধিকে দিনভর আটকে রাখেন বলেও অভিযোগ তাঁর। তিনি আরও বলেন, শুধু তিনি নন, তাঁরা একসঙ্গে প্রায় ১৫ জন ঠিকাদার একই পরিস্থিতির শিকার হন। 

একই ধরনের অভিযোগ করেন স্থানীয়সহ আশপাশের জেলার অন্তত ১০ জন ঠিকাদার। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক ঠিকাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই দিন দরপত্র হাতে কেউই সদর উপজেলা চত্বরে ঢুকতে পারেননি। আমি ভায়নার মোড়ে আমার দরপত্র রেখে উপজেলা চত্বরে যাই। ৩০ থেকে ৫০ জনের একটি দল পুরো উপজেলা চত্বরে অবস্থান করছিল। আমার সামনেই নড়াইলের এক ঠিকাদারের প্রতিনিধির কাছ থেকে দরপত্র কেড়ে নিয়ে মারপিট করা হলো। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তখন কে যাবে মার খেতে। শেষ পর্যন্ত দরপত্র জমা না দিয়েই ফিরে আসি।’

অভিযোগের বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরপত্র জমা নেওয়ার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। আমাদের কার্যালয়ের মধ্যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।’ সদর উপজেলার পিআইও মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের বাক্সে নির্ধারিত সময়ে একটিও দরপত্র জমা পড়েনি। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের দায়িত্বে অবহেলার ঘটনা ঘটেনি। কেউ কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছে এমন কোনো অভিযোগও আমার কাছে আসেনি।’ 

ঠিকাদারদের অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা দরপত্র জমাদানে বাধা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মীর মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক আলী হোসেন। তাঁরা বলেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মী দরপত্র কেনেননি। তাহলে তাঁরা কেন এই কাজে বাধা দিতে যাবেন? এগুলো ব্যবসায়ীদের বিষয়। ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মীর এখানে সম্পৃক্ততা নেই। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, মূলত ব্যবসায়ীদের দাবির ভিত্তিতে দলের নেতাদের নির্দেশে সবকিছু হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল, জেলার কাজ যেন জেলার ঠিকাদারেরাই করেন, যাতে কাজটা ভালো হয়, আর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হন। 

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, এর সঙ্গে দলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। জেলা আওয়ামী লীগের কোনো বৈঠকে এসব বিষয়ে কখনোই আলোচনা হয়নি। এখন ব্যক্তি পর্যায়ে কোনো নেতা এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তার দায় দলের ওপর দিলে হবে না।