বাল্যবিবাহের শিকার ছেলেশিশুরাও

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েশিশুদের নিয়ে চিন্তিত সরকার, বেসরকারি সংস্থাসহ সবাই। তবে বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে ছেলেশিশুরাও। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌতুকের লোভে অথবা দাদা-দাদি মারা যাওয়ার আগে নাতিবউ দেখে যেতে চান—এ ধরনের অজুহাতে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাল্যবিবাহের শিকার ছেলেশিশুরাও বিভিন্ন ট্রমা ও ঝুঁকির মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে।

২০১৭ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী, বিয়ের ক্ষেত্রে ২১ বছর পূর্ণ হয়নি—এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি—এমন কোনো নারীকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলা হয়েছে।

ছেলেশিশুর বিয়ের বিষয়টি সামনে এনেছে চলতি মাসেই জাতিসংঘ শিশুবিষয়ক তহবিল (ইউনিসেফ) পরিচালিত প্রথম গবেষণা জরিপের ফলাফল। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সংস্থাটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বে বছরে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি ছেলেশিশুর বিয়ে হচ্ছে। এই ছেলেশিশুদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজনের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগেই। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরিতে ৮২টি দেশের মানুষের বৈবাহিক অবস্থা ও জনসংখ্যাগত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে ইউনিসেফ।

ইউনিসেফের এ গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশুর উপস্থিতি রয়েছে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে। এই হার ২৮ শতাংশ। এরপর রয়েছে যথাক্রমে নিকারাগুয়ায় ১৯ শতাংশ ও মাদাগাস্কারে ১৩ শতাংশ। প্রতিবেদন বলছে, যারা পরে বিয়ে করে, তাদের তুলনায় যেসব শিশু বাল্যবিবাহের শিকার, তাদের মধ্যে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা কম, নির্যাতন ও মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। আশার কথা হলো, এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কোনো তথ্য আলাদাভাবে স্থান পায়নি।

তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কিছু তথ্য-উপাত্তে ছেলেশিশুর বিয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ২০১৭ অনুযায়ী, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রতি হাজারে প্রায় ১২০ জন মেয়ে এবং প্রায় ১৪ জন ছেলের বিয়ে হয়। এ সংস্থার ‘জেন্ডার স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ ২০১৮’ অনুযায়ী, দেশে সাধারণত স্ত্রীর চেয়ে স্বামীর বয়স বেশি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর চেয়ে ১০ বছর বা তারও বেশি বয়সের হয়। তবে পরিসংখ্যানে স্ত্রীর চেয়ে স্বামীর বয়স কম, সে চিত্রও দেওয়া আছে। ২০১২-১৩ সালের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দেশের সাতটি বিভাগে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের (৩১০৮ জন) ০ দশমিক ৩ শতাংশ স্বামীর বয়স স্ত্রীর চেয়ে কম ছিল। মোট স্বামীর ১ দশমিক ৫ শতাংশের বয়স জানা যায়নি। স্বামীর বয়স কম—শহরে সংখ্যাটি ০ দশমিক ২ শতাংশ আর গ্রামে তা ০ দশমিক ৪ শতাংশ।

জুন মাসেই প্রকাশিত বিবিএসের প্রতিবেদন ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিককালে পুরুষদের ক্ষেত্রে বিয়ের গড় বয়স কিছুটা নিম্নমুখী। পুরুষদের বিয়ের বয়স ২০১৫ সালে ছিল ২৫ বছর ৩ মাস, যা ২০১৭ ও ২০১৮ সালে কমে যথাক্রমে ২৫ বছর ১ মাস ও ২৪ বছর ৪ মাসে দাঁড়ায়। এতে বাল্যবিবাহের কথা বলা না হলেও ছেলেদের বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স কমছে, সে ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছে।

তবে এখন পর্যন্ত ছেলেশিশুর বিয়ের বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটির কাছে শিশু অধিকার সনদের পঞ্চম প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৫ সালে কমিটি এ পঞ্চম প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সমাপনী পর্যবেক্ষণে বাল্যবিবাহকে ক্ষতিকর চর্চা হিসেবে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কমিটি বলেছে, দেশের বিদ্যমান আইনে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর নির্ধারণ করা হলেও শিশুবিবাহ, মূলত কন্যাশিশুর বিয়ের হার অনেক বেশি, যা খুবই উদ্বেগজনক। কমিটি এ ধরনের ক্ষতিকর চর্চা বন্ধে রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেছে।

২০১৪ সালের জুলাই মাসে ইউনিসেফ ও যুক্তরাজ্য সরকারের যৌথ আয়োজনে ২১ থেকে ২৩ জুলাই লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছর বয়সের আগে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছিলেন।

ছেলেশিশুর বাল্যবিবাহ
গণমাধ্যম, বিশেষ করে প্রথম আলোয় প্রকাশিত বাল্যবিবাহসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেও ছেলেশিশুর বিয়ের চিত্র পাওয়া গেছে। ২০ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ছেলেমেয়ের বিয়ের আয়োজনে বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিলেন চারটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চারজন চেয়ারম্যান। সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ওই বিয়েতে যান তাঁরা। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারা ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেন। বরসহ কয়েকজন পালিয়ে যান। ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেয়েটি সদর উপজেলার স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার অপ্রাপ্তবয়স্ক এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় সে। অ্যাফিডেভিট করে বয়স বাড়িয়ে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে করে তারা। পারিবারিকভাবে এ বিয়ে মেনে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়।

ছেলেমেয়ে পালিয়ে বিয়ের ঘটনা ছাড়াও পরিবার ছেলেশিশুর বিয়ে দিচ্ছে। গত বছরের মার্চ মাসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলায় স্কুলপড়ুয়া এক কিশোরীর (১৫) বিয়ের আয়োজনে গিয়ে হাজির হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফরিদা ইয়াসমিন। পরে কিশোরীর পরিবার ও পাত্রপক্ষের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বাল্যবিবাহটি বন্ধ করেন তিনি। ওই কিশোরী বারহাট্টার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। তাঁর সঙ্গে তৌফিক খাঁ (২০) নামের এক তরুণের বিয়ের আয়োজন চলছিল।

ইউএনও ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বললেন, দেশে ছেলেশিশুর বিয়ে দেওয়ার ঘটনা এখনো কম। তবে হচ্ছে না, তা বলার উপায় নেই। পাঁচটি মেয়ের বাল্যবিবাহ হলে একটি বা দুটি পাওয়া যায়—ছেলে বা বরের বয়সও কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ের বাড়ি থেকে অটো, ভ্যান দেবে—এ ধরনের যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে দাদা-দাদির বায়না মেটাতেও ছেলেশিশুকে হয় আত্মীয়ের মধ্যে, না হয় অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

২০১৭ সালের জুন মাস থেকে এ পর্যন্ত ফরিদা ইয়াসমিন ৫০টির বেশি বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অল্প বয়সে মা হওয়াসহ বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে মেয়েরা। সেই বিবেচনায় বিয়ে ঠেকানো মেয়ের পরিবার দরিদ্র হওয়ায় কয়েকজন মেয়েকে ব্যক্তিগতভাবে পড়াশোনার খরচসহ বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছি। ছেলেশিশুর কথা তেমনভাবে চিন্তা করিনি। তবে এরপর থেকে ছেলেশিশুর জন্যও কিছু করার চেষ্টা করব।’

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদও প্রায় একই কথা বললেন। তিনি বলেন, ছেলেশিশুদের যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের প্রসঙ্গটি যেমন আলোচনায় আসে না, একইভাবে ছেলেশিশুর বিয়ের খবরটিও আলোচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। গুরুত্বের বাইরে থাকার কারণে শিশু অধিকার ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে কত মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে, শুধু সে পরিসংখ্যানই রাখছে। তবে সময় হয়েছে ছেলেশিশুর বিয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া।

ইউনিসেফের বিজ্ঞপ্তিতে ছেলেশিশুর বিয়েসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেছেন, বাল্যবিবাহ শৈশব কেড়ে নেয়। শিশুবরেরা পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়; অথচ এ ব্যাপারে তারা তৈরি না-ও থাকতে পারে। বাল্যবিবাহ একটি ছেলেশিশুকে আগাম পিতৃত্বের দিকে ঠেলে দেয়। এটি পরিবারের দায়দায়িত্ব বহনে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। শিক্ষা ও চাকরি লাভের সুযোগ সীমিত করে।