'এত করে কলাম, আমারে মারিস না'

দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত শাহীন। ছবি: সংগৃহীত
দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত শাহীন। ছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ছবিটি। তাতে দেখা যায়, রক্তাক্ত এক কিশোর বসে আছে, তাকিয়ে অপলক দৃষ্টিতে। হামলার সময় প্রাণ বাঁচাতে দুর্বৃত্তদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিল যশোরের ওই কিশোর শাহীন আলম (১৬)। কিন্তু নিস্তার মেলেনি। চেতনা থাকা অবস্থায় মাঝে মাঝেই চিৎকার দিয়ে শাহীন বলে উঠছিল, ‘এত করে কলাম, আমারে মারিস না। ওরা কয় তোর নিস্তার নেই।’

শাহীন এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বাইরে ঠায় বসে আছেন তার মা মোসাম্মত খাদিজা। তিনি জানান, চেতনা থাকা অবস্থায় মাঝে মাঝেই চিৎকার করে উঠত শাহীন। বলে উঠত, দুর্বৃত্তদের কাছে তার মিনতির কথা। আহত শাহীন স্বজনদের শুধু এটুকুই বলতে পারছিল।

শাহীনকে গতকাল শনিবার রাতে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। রাতে অপারেশন শেষে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। শাহীনের মা খাদিজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুক্রবার সকালে সাতটার সময়ে শাহীন ভ্যান নিয়ে বাইর হয়ে যায়। দুপুরে গ্রামের মেম্বার ফোন করে শাহীনের কথা জানায়। প্রথমে শুনেছিলাম ও মারা গেছে। পরে ওরে আমরা খুলনা হাসপাতালে নিয়ে যাই। পথের মধ্যেই বারবার চিল্লায়ে উঠতেছিল, “এত করে কলাম, আমারে মারিস না। ওরা কয় তোর নিস্তার নেই।’”

যশোরের কেশবপুরের গোলাঘাটা দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহীন গত শুক্রবার দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হয়। ওই দিন যাত্রীবেশী কয়েকজন দুর্বৃত্ত তার ভ্যানটি ভাড়া নেয়। শাহীন তাদের নিয়ে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানার ধানদিয়ার নামক এলাকায় যাচ্ছিল। পথে একটি পাটখেতের পাশে শাহীনের ভ্যানটি দাঁড় করায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় তারা শাহীনের মাথায় আঘাত করে ভ্যানটি নিয়ে পালিয়ে যায়। আঘাত ও রক্তক্ষরণের ফলে অচেতন হয়ে পড়েছিল শাহীন। পরে চেতনা ফিরলে কাঁদতে শুরু করে সে। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানায় খবর দেয়।

শাহীনের খালু রবিউল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ভ্যান ও শাহীনের সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন—সবই নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। শাহীন মারা গেছে ভেবে ওরা ফেলে রেখে চলে যায়। প্রথমে শাহীনকে সাতক্ষীরা হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাকে খুলনার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে নেওয়া হয়। খুলনার চিকিৎসকেরা জানান, শাহীনের মাথায় মারাত্মক জখম হয়েছে, ঢাকা মেডিকেলে নিতে হবে। শনিবারই ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয় শাহীনকে।

কেশবপুর থানার মঙ্গলকোট গ্রামে শাহীনদের বাড়ি। বাবা হায়দার আলী মোড়ল একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত ভ্যান কিনেছিলেন। বাড়তি রোজগারের আশায় পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে শাহীনও ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। মা খাদিজা বলেন, তাঁর ছেলে পড়াশোনায় ভালো। ছোট দুই বোনের পড়াশোনার প্রতিও নজর ছিল শাহীনের।

দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত যশোরের কিশোর শাহীন এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আছে। বাইরে তার মা মোসাম্মত খাদিজা ছেলের সুস্থতার জন্য অপেক্ষা করছেন। ৩০ জুন, ঢাকা। ছবি: সুহাদা আফরিন
দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত যশোরের কিশোর শাহীন এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আছে। বাইরে তার মা মোসাম্মত খাদিজা ছেলের সুস্থতার জন্য অপেক্ষা করছেন। ৩০ জুন, ঢাকা। ছবি: সুহাদা আফরিন

সংসারের উপার্জনের বাহনটি ছিনতাই হলেও মায়ের চিন্তা এখন শুধুই ছেলের সুস্থতা নিয়ে। কখন ছেলের জ্ঞান ফিরবে, সেই আশায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বারান্দায় স্বজনদের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন খাদিজা। তিনি বলেন, ‘ছেলে আমার জানে বাঁচি গেছে। আল্লাহ এখন ওকে সুস্থ করে দিলেই আমার শান্তি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অসিত চন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহীনের মাথার হাড় ফেটে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। গতকাল ভর্তি হওয়ার পর পরই অপারেশন হয়েছে। ওর ইনজুরিটা একটু ক্রিটিক্যাল। তাই আইসিইউতে আছে। ওর চিকিৎসায় সাত সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করা হয়েছে।’

শাহীনের বাবা হায়দার আলী মোড়ল বাদী হয়ে গতকাল শনিবার পাটকেলঘাটা থানায় মামলা করেছেন। সাতক্ষীরা থেকে প্রথম আলোর প্রতিবেদক জানান, অপরাধীদের ধরতে সাতক্ষীরা ও যশোরের পুলিশ যৌথ অভিযান চালাচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, শনিবার রাত থেকে অভিযান শুরু করেছে। দ্রুতই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম আলোয় শাহীনকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর একজন ইতালিপ্রবাসী তাঁর কাছে শাহীনের বাবা-মাকে দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেসসচিব আশরাফুল আলম খোকন এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন,  যশোর থেকে ঢাকা মেডিকেলে আসা এবং অপারেশন থেকে শুরু করে চিকিৎসার সব কাজে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা–কর্মীরা সহায়তা করেছেন। তিনি পোস্টে আরও লিখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর বিশেষ সহকারী  বিপ্লব বড়ুয়াও যোগাযোগ রাখছিলেন।