সাক্ষীদের বয়ান: গুলি করে খুনের পরও লাশ কুপিয়েছিল জঙ্গিরা

ঠিক তিন বছর আগে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নিরীহ লোকজনকে গুলি করে মেরে ফেলার পরও লাশগুলো কুপিয়েছিল জঙ্গিরা। চোখের সামনে জঙ্গিদের এমন নৃশংস আচরণ দেখেন ওই সময় হোলি আর্টিজানে জিম্মি হয়ে পড়া ফাইরুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়া। দুজনই আদালতে দেওয়া তাঁদের জবানবন্দিতে ভয়াবহ সেই ঘটনার বর্ণনা দেন। ২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট আদালত তাঁদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে জঙ্গিরা হামলা চালায়। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। পরে পুলিশ ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান একজন রেস্তোরাঁকর্মী।

ফাইরুজ মালিহার জবানবন্দি
দুই বন্ধু ফাইরুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়া ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৮টা ১০ মিনিটের দিকে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে যান। সেখানে ছিলেন ফাইরুজের বন্ধু তাহমিদ।

ফাইরুজ মালিহা জবানবন্দিতে বলেন, ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে প্রথমে একটা গুলির আওয়াজ পান। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন, এটা বোধ হয় পটকার শব্দ। এর কিছুক্ষণ পর তিন থেকে চারজন যুবক হোলি আর্টিজানে ঢোকার প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকছেন। সবার কাঁধে একটা করে ব্যাগ। এর মধ্যে একজন দ্রুত এগিয়ে সামনে যান। যে টেবিলে চার-পাঁচজন বিদেশি বসেছিলেন সেখানে তাঁরা গুলি করেন। তারপর তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করে চলে আসেন। তখন তিনি ও তাহমিদ বাংলায় তাঁদের কাছে প্রাণভিক্ষা চান। ছেলেটি ইংরেজিতে তাঁদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁরা মুসলিম কি না।

জঙ্গি হামলায় তছনছ হোলি আর্টিজান বেকারি প্রাঙ্গণ (ফাইল ছবি)
জঙ্গি হামলায় তছনছ হোলি আর্টিজান বেকারি প্রাঙ্গণ (ফাইল ছবি)

হামলা চলাকালে জঙ্গি নিবরাস এসে তাঁদের ভেতরে যেতে বলেন। তখন তাঁরা না যেতে চাইলে নিবরাস জানান, তাঁদের কোনো ভয় নেই। ভেতরে আরও একটি পরিবার আছে। তখন তাঁরা ওই ঘরে যান। তাহমিদ তাঁদের টেবিলের নিচে লুকাতে বলেন। পরে তাঁরা টেবিলের নিচে চলে যান। সেখান থেকে তাঁরা দেখেন, জঙ্গিরা একজন বিদেশি নারীকে শৌচাগার থেকে টেনে বের করে এনে গুলি করছে। তারপর ওই নারীকে কোপাতে থাকে। প্রায় ৩০ মিনিটের মতো তাঁরা সেখানে লুকিয়ে থাকেন। তারপর নিবরাস এসে তাঁদের মাথা নিচু করে চেয়ারে বসতে বলেন। সেই সময় জঙ্গিরা রান্নাঘরের দরজা ভাঙার চেষ্টা করে, কিন্তু পারছিল না।

জঙ্গিরা ফাইরুজ মালিহাকে বলে, তিনি যেন পুলিশকে ফোন দিয়ে বলেন, এখানে যেন পুলিশ আক্রমণ না করে। আক্রমণ করলে সবাইকে তারা মেরে ফেলবে। এ ঘটনা তিনি মুঠোফোনে মাকে জানান। হাসনাত করিম তাঁর চাচাকে ফোন দেন। এরপর রেস্টুরেন্টের লাইট বন্ধ করে দেয়।

জবানবন্দিতে ফাইরুজ মালিহা আরও বলেন, একজন জঙ্গি বেকারি থেকে কেক এনে দিয়ে সেগুলো খেতে বলে। তখন দুই জঙ্গি আবারও বলে, তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তবে ঝামেলা করলে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে না। ওপর থেকে একজন জঙ্গি নেমে আসে। রান্নাঘরের দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু না পেরে টেবিল ভাঙার চেষ্টা করে। লাশগুলো কোপাতে থাকে। এ সময় নিবরাসও ওপরে চলে যায়। অন্য একজন নেমে আসে।

রাত দেড়টার দিকে জঙ্গিরা একজন বাঙালি ও একজন জাপানি নাগরিককে নিয়ে আসে। কর্মচারীদের বসার টেবিলে তাঁদের বসায়। তখন জঙ্গি রোহান জাপানি নাগরিককে পরপর দুটি গুলি করেন।


রাত দুইটার দিকে রোহান তাঁদের ফোন দিয়ে অনেক ছবি তোলেন। রোহান আবার ওপরে চলে যান। তারপর তিন জঙ্গি আবার নিচে নেমে আসে।

সবাই মিলে তখন রান্নাঘরের দরজা খুলে ফেলে। রাত তিনটার দিকে ওয়েটার এসে টেবিল পরিষ্কার করে দেন। তারপর টেবিলে মাছভাজা দিয়ে তাঁদের সাহ্‌রি করে রোজা রাখতে বলে। সবাই তখন বাধ্য হয়ে খান। তারপর টেবিল পরিষ্কার করা হয়। ফজরের আজান হয়।

সকাল সাতটার দিকে একজন জঙ্গি ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। জঙ্গি রোহান সবাইকে দাঁড়াতে বলেন। রোহান হাসনাত করিমের হাতে চাবি দিয়ে দরজা খুলতে বলেন। নিবরাস সবার ফোন ফেরত দেন। হাসনাত দরজা খুলে চলে আসেন। রোহান সবাইকে একেক করে বেরিয়ে যেতে বলেন।
সবার আগে হাসনাত করিম তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে অসেন। এরপর তাঁরা একে একে বেরিয়ে আসেন।

তাহানা তাসমিয়ার জবানবন্দি
তাহানা জবানবন্দিতে বলেন, জঙ্গিদের কথামতো সেদিন তাঁরা মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে জঙ্গিরা লাইট বন্ধ করে দেয়। তিনি বলেন, ধারালো অস্ত্র দিয়ে মানুষকে কোপানোর শব্দ পাচ্ছিলাম।