সুনামগঞ্জে ৩০ লাখ টাকা খোয়ানোর পর জানলেন পুরোটাই ভুয়া

সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জ

হাওরের কিছু জমি বন্দোবস্ত নিতে চেয়েছিলেন উজ্জ্বল মিয়া (৬৩)। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভাতিজির ‘চালাক-চতুর’ স্বামী অপু চৌধুরীকে। অপু কাজের কথা বলে টাকা নিতে শুরু করেন। এরপর দুই বছরে উজ্জ্বল ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী, মহাপরিচালক, জেলা প্রশাসনের বড় বড় কর্মকর্তাদের এ–সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছেন। 

উজ্জ্বল মিয়া ভাবেন, কাজ তো ভালোই হচ্ছে। এ জন্য দুই বছরে অপু চৌধুরীকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি। টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার মূল রসিদও দেওয়া হয়েছে তাঁকে। সর্বশেষ সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ‘নির্বাহী কর্মকর্তা’র নামে স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে ওই জমি বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয় কাগজ বুঝে নেওয়ার জন্য উজ্জ্বলকে আসতে বলা হয়। তারিখ অনুযায়ী গতকাল সোমবার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করার পর তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। জানতে পারেন সবই ভুয়া। তিনি প্রতারিত হয়ে এই টাকা খুইয়েছেন।

উজ্জ্বল মিয়ার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের উত্তরপাড়া বড়কাশিয়া গ্রামে। তাঁর শ্বশুরবাড়ি সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার মামুদনগর গ্রামে। ওই গ্রামের পাশের ধানকুনিয়া হাওরে উজ্জ্বল মিয়ার কিছু জমি আছে। বোরো মৌসুমে তিনি শ্বশুরবাড়ি এসে এসব জমি আবাদ করেন। তাঁর জমির পাশেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) তিন একর ৩০ শতাংশের একটি ডোবা আছে। 

গতকাল বিকেলে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে কথা হয় উজ্জ্বল মিয়া ও তাঁর ছেলে হীরা মিয়ার সঙ্গে। প্রতারণার কথা জানতে পেরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন উজ্জ্বল। ‘আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে, আমার সব গেছে’ বারবার এ কথা বলে বিলাপ করছিলেন।

আলাপকালে উজ্জ্বল জানান, হাওরের ওই ডোবা কীভাবে বন্দোবস্ত পাওয়া যায়, এ নিয়ে অপু চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। অপু জানান, তিনি সব করে দেবেন। অপু চৌধুরীর মূল বাড়ি সিলেট শহরে হলেও দীর্ঘদিন থেকেই মোহনগঞ্জে বসবাস করছেন। তিনি এই ডোবা ১০ বছরের জন্য বন্দোবস্ত এনে দেওয়ার সব কাজ করে দেবেন বলে উজ্জ্বল মিয়াকে জানান। এরপর থেকে অপু চৌধুরী ভূমি মন্ত্রণালয়, পাউবোর প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ এবং এসব বিষয়ে খরচের কথা বলে টাকা নিতে শুরু করেন। বিভিন্ন সময় কাজের অগ্রগতির চিঠিও পান উজ্জ্বল মিয়া। মন্ত্রণালয়, পাউবো, আয়কর বিভাগের প্যাডে বড় বড় কর্মকর্তার নাম ও স্বাক্ষর করা এসব চিঠি পেয়ে কাজ হচ্ছে বলে উজ্জ্বল মিয়ার ধারণা হয়। তাই তিনি টাকা দিতে থাকেন। অপু চৌধুরী টাকা জমা দেওয়ার প্রমাণ হিসেবে সোনালী ব্যাংক সিলেটের আম্বরখানা শাখার সিল দেওয়া চালান তাঁকে দেন। এ রকম টাকা জমা দেওয়ার ৮০টি চালানের কপি দেখান উজ্জ্বল মিয়া। এ ছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়, পাউবো, আয়কর বিভাগের বেশ কিছু চিঠি রয়েছে তাঁর কাছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব, পাউবোর প্রধান প্রকৌশলীসহ বড় বড় কর্মকর্তার নাম, সিল ও স্বাক্ষর আছে তাতে। 

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ‘নির্বাহী কর্মকর্তা’ আফতাব আহমেদের নামে স্বাক্ষরিত একটি চিঠি উজ্জ্বলের কাছে পাঠান অপু চৌধুরী। এতে উজ্জ্বল মিয়াকে স্থায়ীভাবে ডোবা বন্দোবস্তের কাগজপত্র গ্রহণের জন্য ৩০ জুন রোববার আসতে বলা হয়। সে অনুযায়ী রোববার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সুনামগঞ্জ আসেন তিনি। কিন্তু রোববার সারা দিন অপুকে ফোনে আসতে বলার পরও তিনি আর আসেননি। পরে গতকাল বাবা ও ছেলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদের সঙ্গে দেখা করেন। কাগজপত্র দেখে জেলা প্রশাসক জানিয়ে দেন সবই ভুয়া। উজ্জ্বল প্রতারিত হয়েছেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘নির্বাহী কর্মকর্তা’ বলে কোনো পদ বা আফতাব আহমেদ নামের কোনো কর্মকর্তা নেই। 

উজ্জ্বল মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে সিঙ্গাপুর ছিল। সে টাকা দিত। আমার একটা ছোট মুদিদোকান আছে। আমার কামাই, ছেলের কামাই সব দিয়া দিছি। আমি তো শেষ হয়ে গেছি। আমি এর বিচার চাই।’ উজ্জ্বল মিয়ার ছেলে হীরা মিয়া বলেন, ‘আমি মাসখানেক হয় সিঙ্গাপুর থেকে দেশে এসেছি। কাগজপত্র দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো ভুয়া। কালার প্যাড, বড় বড় কর্মকর্তার নাম, সিল, স্বাক্ষর সবই আছে। কিন্তু আজ এখানে এসে বুঝলাম আমাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে।’

অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে অপু চৌধুরীর মুঠোফোন নম্বরে ফোন দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ বলেন, ‘উজ্জ্বল মিয়াকে দেখে সহজ-সরল মনে হয়েছে। তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তিনি যেসব কাগজপত্র দেখিয়েছেন, সবই ভুয়া। আমরা তাঁর বক্তব্য নিয়েছি। আমরাও বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।’