'ধর ধর' বলে প্রবীণ অধ্যাপকের গায়ে কেরোসিন ঢাললেন শিক্ষার্থী

প্রথমেই পাঁচতলার অফিস কক্ষে গিয়ে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তিনি অফিস থেকে বের হয়ে নিচে নামার জন্য লিফটে উঠলে ওই শিক্ষার্থীদের কয়েকজনও সেখানে ঢুকে পড়েন। এরপর লিফট থেকে নেমে ওই শিক্ষক সামনে এগোতে থাকলে ‘ধর ধর, ধাক্কা দে, ধাক্কা দে’ বলে সাত-আটজন শিক্ষার্থী তাঁর পিছু নেন। এর মধ্যে দুজন তাঁকে ধাক্কাও দিয়ে বসেন। পরে একজন তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা মাসুদ মাহমুদকে এভাবেই লাঞ্ছিত করা হয়। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে উঠে এসেছে এই তথ্য। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ ঘটনা ঘটে।

মাহমুদুল হাসান নামের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির এক শিক্ষার্থীই প্রবীণ এই অধ্যাপকের গায়ে কেরোসিন দেন বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। ক্যাম্পাস থেকে তাঁকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব কুমার চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাহমুদুল হাসানই শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের কাছে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। উত্তেজনা থেকেই কেরোসিন দিয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।’

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ কুমার বড়ুয়া মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান ওসি প্রণব চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ওই ছেলের (মাহমুদুল হাসান) উদ্দেশ্য খারাপ ছিল। কেরোসিন দেওয়ার পর হয়তো আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারত।’

শিক্ষককে নিগৃহীত করার পর ওই শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামনের জাকির হোসেন সড়কে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সড়কের দুই পাশে যানজট লেগে যায়। পরে পুলিশ গেলে তাঁরা সটকে পড়েন। শিক্ষককে নিগৃহীত করার ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষকের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ কুমার বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অফিস থেকে নিয়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা করেই তারা আক্রমণ করেছে।

একই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, যে ছেলেটি ঘটনা ঘটিয়েছে সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে।

উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রায় ৪০ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর তিন বছর আগে ইউএসটিসির ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রেণিকক্ষে ‘অপ্রাসঙ্গিকভাবে’ যৌনতা বিষয়ে তুলে ধরে পক্ষান্তরে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করেছেন তিনি। গত ২৫ এপ্রিল এ বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে একটি স্মারকলিপিও দেন তাঁরা। সেখানে ইংরেজি বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়ন করা ২৬৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২২ জনের সই ছিল।

তবে শুরু থেকেই যৌন নিপীড়নের অভিযোগটি উদ্ভট ও সত্য নয় বলে দাবি করে আসছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ। মাসুদ মাহমুদের পক্ষে মাঠে নামেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা। পাশাপাশি এই অধ্যাপকের চরিত্রহননের অপচেষ্টা চলছে উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের ৫০৭ বিশিষ্টজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর মাসুদ মাহমুদ ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার মান উন্নত করার লক্ষ্যে কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করেন এবং নতুন কয়েকজনকে নিয়োগ দেন। পাশাপাশি ইংরেজি বিভাগের বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ক্লাস উপস্থিতি বিবেচনায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারান। চাকরিচ্যুত ওই শিক্ষকদের ইন্ধনে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ হারানো শিক্ষার্থীরাই মিলে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন বলে জানান তাঁরা।

দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, দুই জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। প্রবীণ একজন অধ্যাপককে এভাবে লাঞ্ছিত করা নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে।

শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন দেওয়ার ঘটনাকে ন্যক্কারজনক বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. জাকির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ থেকেই প্রমাণিত হয় ওই শিক্ষার্থীদের করা অভিযোগ সঠিক নয়। তাঁরা তাদের অভিযোগ প্রমাণ করতে না পেরে সম্পূর্ণ বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। এর পেছনে যে বড় একটা চক্র কাজ করছে, তাদের শাস্তি না হলে এ রকম ঘটনা আরও ঘটবে।