ছাত্রদলের কমিটি: সামনে 'বয়স' পেছনে কিছু নেতার 'স্বার্থ'

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেতে এবারই প্রথম বয়সের শর্ত যুক্ত করা হয়েছিল। এই শর্ত তুলে নেওয়ার দাবিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গত জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছিল ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ অংশ। এর মধ্যে কার্যালয়ে ভাঙচুর, ডিম ছোড়া, তালা মারা, বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, মারধর, হকিস্টিকের মহড়া, ককটেল নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটেছে। প্রায় তিন সপ্তাহের সহিংস আন্দোলনের পর বিক্ষুব্ধদের কথা শুনতে রাজি হয়েছে বিএনপি। 

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ মূল্যায়ন করে বিএনপি ও ছাত্রদলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বয়সসীমা তুলে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ হলেও এর পেছনে রয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির কয়েকজন নেতা। তাঁরা ছাত্রদলকে দিয়ে দলে প্রভাব ধরে রাখতে সচেষ্ট। এ ছাড়া ছাত্রদলের একটি অংশের পদ-পদবির লোভ এবং তা ব্যবহার করে বিত্তবৈভব গড়ার প্রতিযোগিতাও রয়েছে। তবে ছাত্রদলের এবারের বিক্ষোভে নতুন মাত্রা হচ্ছে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তাঁর সঙ্গে অসদাচরণ করেন বিক্ষুব্ধরা। 

দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপির নেতাদের একটি অংশ এই পরিস্থিতিকে পুঁজি করে রিজভীকে ঘায়েল করতে তৎ​পর ছিল। কারণ, নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রিজভীর থাকা, প্রায়ই সংবাদ সম্মেলন করা ও তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করছেন না ওই নেতারা। তাঁরা ছাত্রদলের বিক্ষোভে রিজভীকে জড়িয়ে তাঁকে কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে সরাতে চান। রিজভীকে অপদস্থ করা এবং এর জেরে ছাত্রদলের ১২ জনকে বহিষ্কার করা হয়।

৩ জুন এক বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি করার ঘোষণা দেওয়া হয়। নতুন কমিটিতে প্রার্থী হওয়ার বয়সসীমার বিষয়ে বলা হয়, ‘২০০০ সাল থেকে পরবর্তী যেকোনো বছরে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।’ ছাত্রদল বিএনপির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। বিএনপির চেয়ারপারসন ছাত্রদলের সাংগঠনিক প্রধান।

ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতাদের অভিযোগ, লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভুল বুঝিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য রিজভীকে সন্দেহ করেন। এ সন্দেহের একটা কারণ, কমিটি বিলুপ্তির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রিজভী সই করেছেন। তবে রিজভী বলেছেন, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে তিনি তাঁর দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেছেন। 

ছাত্রদলের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ নিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা স্পষ্ট করে কিছু বলতে রাজি হননি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রদলের পুরো বিষয়টি বি​এনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেখছেন। ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শামসুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে, তাঁরা দেখছেন। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। ’

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নয়াপল্টন কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাত্রদলের বিলুপ্ত কমিটি ও সংগঠন থেকে সদ্য বহিষ্কৃত নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। 

ছাত্রদলের বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি এজমল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০০ সালে এসএসসি পাস করা একজন ছাত্রের আনুমানিক বয়স ৩৫ বছর। ৩৫-৩৬ বছর বয়সে ছাত্রদল করা গেলে ৩৭-৩৮ বছর বয়সে কেন করা যাবে না?’

দলে প্রভাব বাড়াতে ছাত্রদল
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে বিক্ষোভের নেপথ্যে সব সময় দলের কোনো না কোনো নেতার ইন্ধন থাকে। ছাত্রদলকে নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বাধীনে রেখে দলে নিজেদের প্রভাব-বলয় বাড়ানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকেই এই প্রবণতা বেড়েছে। ছাত্রদলের সাবেক তিন নেতা আমান উল্লাহ, ফজলুল হক ও শহীদ উদ্দীন চৌধুরী দীর্ঘ সময় বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। 

অভিযোগ আছে, বিভিন্ন সময়ে ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা নেতারা ছাত্রদলকে পরিচালনার চেয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়ানোর কাজে সচেষ্ট ছিলেন। যার কারণে দুই বছরের কমিটি চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত বহাল ছিল। সর্বশেষ কমিটিও ছিল প্রায় পাঁচ বছর। 

গত কাউন্সিলে বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের পদটি শূন্য রাখা হয়। কিন্তু প্রভাব বিস্তারের আগের ধারা থেকে ছাত্রদল বের হতে পারেনি। এবারের অস্থিরতার পেছনেও বিএনপির অন্তত দুজন কেন্দ্রীয় নেতার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে দলের ভেতর প্রচার রয়েছে, যাঁরা একসময় দলের ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি বিএনপির সাবেক ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমানে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ।

যেভাবে অনির্বাচিত কমিটির শুরু
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি সংগঠনের প্রতিষ্ঠার পর গত ৪০ বছরে ১৮টি কমিটি হয়েছে। ১৯৭৯ সালে প্রথম কমিটি ছিল নির্বাচিত। এতে এনামুল করিম সভাপতি ও আ ক ম গোলাম হোসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সর্বশেষ নির্বাচিত কমিটি হয় ১৯৯২ সালে। কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে রুহুল কবির রিজভী ও ইলিয়াস আলী। এই কমিটির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র খুনের ঘটনা ঘটে। এরপরই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। তখন বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায়। পরের বছর, ১৯৯৩ সালে ফজলুল হককে সভাপতি ও নাজিম উদ্দিন আলমকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। সেই থেকে ছাত্রদলের অনির্বাচিত কমিটির যাত্রা শুরু হয়। সর্বশেষ ৩ জুন বিলুপ্ত করা রাজীব আহসান-আকরামুল হাসান কমিটি পর্যন্ত ১০টি কমিটিই ছিল অনির্বাচিত।

ছাত্রদলের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বয়সসীমা নিয়ে দল (বিএনপি) একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দলের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হবে। আবার যারা বিক্ষুব্ধ, তাদের ব্যাপারটিও দলকে বিবেচনায় নিতে হবে।

২৯ বছর পর সম্মেলন
প্রায় ২৯ বছর পর আবার কাউন্সিলের মাধ্যমে ছাত্রদলের কমিটি করার উদ্যোগ নেয় বিএনপি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদলের চরম ভরাডুবি হয়। এই বিপর্যয়ের পর বিএনপির মূল্যায়ন হচ্ছে, বয়স্ক নেতৃত্ব ও সাধারণ ছাত্রদের থেকে ছাত্রদল নেতাদের বিচ্ছিন্নতার কারণে ডাকসুতে এত খারাপ ফল হয়েছে। 

ছাত্রদলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আমরা চুজ অ্যান্ড পিকে (পছন্দের লোককে নেতা বানানো) যাব না। ভোটে নেতা নির্বাচন হবে। যারা আন্দোলন করছে, তারা আরেকবার ছাত্রদল করতে চায়। কিন্তু তাদের তো বয়স হয়ে গেছে। এটা তাদের জন্য বেমানান।’