অ্যানেসথেসিয়াতেই সব শেষ

জুয়েল মিয়া।
জুয়েল মিয়া।

হাসপাতালের উপকরণ সরবরাহকারীর দেওয়া অ্যানেসথেসিয়াতে জুয়েল মিয়া (৩২) নামের এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভৈরব পৌর শহরের কমলপুর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে। জুয়েল মিয়া পেশায় পোলট্রি ব্যবসায়ী ছিলেন। তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর বাম হাতের হাড় ভেঙে যায়। সে সময় হাতে সংযোজন করা স্ক্রু ও প্লেট অপসারণ করতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কমলপুরের ভৈরব ট্রমা অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান জুয়েল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তাঁকে অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়া হয়।

পরিবারের সদস্য ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, জুয়েলকে অ্যানেসথেসিয়া দেন গৌরাঙ্গ রায় নামের এক ব্যক্তি। তিনি বিভিন্ন হাসপাতালের ট্রমা চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট উপকরণ সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে জুয়েল মারা যান। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়। পরে র‌্যাব-পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় কামরুজ্জামান আজাদ নামের এক চিকিৎসককে আটক করা হয়। কামরুজ্জামান ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থোপেডিক সার্জন এবং হাসপাতালটির মালিকপক্ষের একজন। মূলত তাঁর নেতৃত্বে জুয়েলের অস্ত্রোপচার হচ্ছিল।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানান, জুয়েল পৌর শহরের চণ্ডীবের দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা। বাবার নাম মো. আলাউদ্দিন। উমর বয়লার হাউস নামে তাঁর একটি পোলট্রি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিন বছর আগে সিএনজিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনায় হাতের হাড় ভাঙার পর এই হাসপাতালেই জুয়েলের অস্ত্রোপচার হয়েছিল। কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে তখন হাতে স্ক্রু ও দুটি প্লেট সংযোজন করা হয়। এর মধ্যে স্ক্রু ও প্লেট অপসারণের সময় হয়ে গেছে। কামরুজ্জামানের পরামর্শে গতকাল বৃহস্পতিবার জুয়েলের অস্ত্রোপচারের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। গৌরাঙ্গ থাকেন চট্টগ্রামে। অ্যানেসথেসিয়া করাতে চট্টগ্রাম থেকে গৌরাঙ্গকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে ডেকে আনেন কামরুজ্জামান। গতকাল পৌঁছে ছিলেন গৌরাঙ্গ।

কামরুজ্জামান, গৌরাঙ্গ ও মো. ইমরান নামের একজন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে জুয়েলকে অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়া হয়। অ্যানেসথেসিয়ার ওপর ইমরানের এক বছরের একটি প্রশিক্ষণ করা আছে।

অস্ত্রোপচার কক্ষে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া নিয়ে কামরুজ্জামান, গৌরাঙ্গ আর ইমরানের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দেয়। কামরুজ্জামানের ইচ্ছে, জুয়েলের হাত পর্যন্ত অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া এবং ব্লকের মাধ্যমে দেওয়া। কিন্তু ইমরান জানালেন, ব্লক ঝুঁকিপূর্ণ এবং সেটি তিনি যথাযথভাবে করতে পারেন না। ইমরান করতে অপারগতা প্রকাশ করার পর গৌরাঙ্গ এসে ওই কাজ করেন। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে জুয়েলের দেহ নিথর হয়ে পড়ে। জুয়েলের মৃত্যু হয়েছে জেনে স্বজনেরা ক্ষুব্ধ হয়ে ভাঙচুর শুরু করলে কর্মরত ব্যক্তিরা হাসপাতাল ছেড়ে যান। কামরুজ্জামান বের হওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁকে আটক করে রাখে। কিছু সময় পর র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

জুয়েলের বড় ভাই কামাল মিয়া বলেন, ‘অস্ত্রোপচার করার আগে আমার ভাইয়ের জরুরি পরীক্ষাগুলো করা হয়নি। অস্ত্রোপচার শুরু হওয়ার আগে ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। রাত নয়টার দিকে কামরুজ্জামান বের হয়ে আমাদের বলেন, সবকিছু খুবই ভালোভাবে হয়েছে। কোথাও সমস্যা থাকার কথা না। কিন্তু এখন জুয়েলের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এই কারণে জুয়েলকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। পরে জানতে পারি, তার আগেই আমার ভাই মারা গেছে।’

কথা হয় অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার দায়িত্বে থাকা মো. ইমরানের সঙ্গে। ইমরান জানালেন, ‘আমাকে ব্লক দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু আমি এই কাজ ভালো করে পারি না। সে কারণে রাজি হইনি। আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিতে বলা হয়। আমি তা–ই করি। এরপরের সবকিছু করেন গৌরাঙ্গ। তবে আমি পাশে ছিলাম। স্ক্রু অপসারণের সময় হঠাৎ করে জুয়েলের রক্তবমি হয়। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারিনি।’ ইমরানের ধারণা, জুয়েলের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল।

এদিকে দিবাগত রাত দেড়টার দিকে কামরুজ্জামানকে পুলিশি প্রহরায় থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কথা হয় কামরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি স্বীকার করেন, গৌরাঙ্গ উপকরণ সরবরাহকারী। ইমরান অ্যানেসথেসিয়া দেন এবং গৌরাঙ্গ সহযোগিতা করেন বলে দাবি করেন কামরুজ্জামান।

একজন উপকরণ সরবরাহকারী কীভাবে অস্ত্রোপচার কক্ষে থাকেন—এমন প্রশ্নে কামরুজ্জামানের উত্তর, এসব কাজে গৌরাঙ্গের দক্ষতা রয়েছে। সে কারণে পাশে রাখা হয়েছিল। এর চেয়ে বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

মুঠোফোন বন্ধ করে রাখায় চেষ্টা করেও গৌরাঙ্গ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

রাতে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আনিসুজ্জামান এবং ভৈরব ও কুলিয়ারচর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার রেজওয়ান দিপুর নেতৃত্বে ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

সহকারী পুলিশ সুপার রেজওয়ান দিপু জানান, রাতেই জুয়েলের মরদেহ কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনায় জুয়েলের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মরদেহ কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হলেও সকালে জানানো হয়েছে, ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে।

কিশোরগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন হাবিবুর রহমান বলেন, উপকরণ সরবরাহকারী উপকরণ সরবরাহ করবেন, এটাই তাঁর কাজ। তাঁর স্থান অস্ত্রোপচার কক্ষে হতে পারে না। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় তদন্ত করা হবে বলে জানান তিনি।

হাবিবুর রহমান বলেন, কিশোরগঞ্জে ময়নাতদন্তের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। সে কারণে জটিল এবং বিশেষ ময়নাতদন্তগুলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।