তাঁর কাছে আছে দুর্লভ সব বৃক্ষ

নিজের বাগানে সুন্দরীগাছের সামনে মাহবুব ইসলাম। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে বাজারভদ্রঘাট শেখপাড়া গ্রামে।  প্রথম আলো
নিজের বাগানে সুন্দরীগাছের সামনে মাহবুব ইসলাম। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে বাজারভদ্রঘাট শেখপাড়া গ্রামে। প্রথম আলো

শখের বশে ডাকটিকিট, ধাতব মুদ্রা, পুরোনো আমলের বনেদি গাড়ি সংগ্রহে রাখেন অনেকে। কিন্তু দুর্লভ বৃক্ষ সংগ্রহে রাখার কথা সচরাচর শোনা যায় না। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে এক তরুণের সন্ধান পাওয়া গেছে, যিনি দুর্লভ গাছের এক বাগান গড়ে তুলেছেন। সাধারণত উপকূলে লোনাজলের কাদামাটিতে জন্মায় সুন্দরীগাছ। সেই গাছও তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন উত্তরাঞ্চলে দোআঁশের কাদামাটিতে। আবার পাহাড়ের রুক্ষ, ঊষর মাটি ছাড়া টেকে না, এমন গাছও তিনি অতি যত্নে লালন করছেন সমতলে। গাছ জোগাড় করতে কক্সবাজার গিয়ে হাতির আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন। আরেকবার বৃষ্টির মধ্যে গাছ লাগাতে গিয়ে বজ্রপাতে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তবু গাছের নেশা তিনি ছাড়েননি। বৃক্ষপ্রেমী এই তরুণের নাম মাহবুব ইসলাম। বয়স ত্রিশের কোটায়। কামারখন্দের বাজারভদ্রঘাট শেখপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। সেখানেই তাঁর এক একরের বিচিত্র সেই বাগান, যেখানে রয়েছে ৪৫ প্রজাতির দুর্লভ গাছ।

গোড়ার কথা
২০০৩ সালের দিকে ইউক্যালিপটাসগাছ লাগানোর হিড়িক পড়ে গেল এলাকায়। মাহবুব খোঁজ নিয়ে জানলেন, বিদেশি এই গাছ আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। গাছটা প্রচুর পানি শোষণ করে। আর এর কোনো ফল হয় না। পাখপাখালি বসে না এর ডালে। সবাই লাগাল ইউক্যালিপটাস। তিনি বাড়ির আশপাশে লাগালেন বেশ কিছু দেশি ফলের গাছ। সেই থেকে শুরু।
গাছের প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বন কর্মকর্তা আবুল কাশেম। ২০১০ সালে তিনি যখন রাজশাহীতে ছিলেন, তখন মাহবুবকে সরকারি দামে ৭০০ সেগুনগাছ দিয়েছিলেন। পরে এই মানুষটিই দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে চিঠি লিখে, ফোন করে গাছের চারা সংগ্রহে মাহবুবকে সহযোগিতা করেছিলেন।
একসময় সুন্দরীগাছের নেশা চাপে। চারার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দেন মাহবুব। সবাই তাঁকে সুন্দরবনে যেতে বলেন। মাহবুবের আর সুন্দরবনে যাওয়া হয় না। খুঁজে পান খুলনার দাকোপের এক শিক্ষার্থীকে। সুন্দরীর চারা জোগাড় করে দিতে বলেন তাঁকে। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার আগে ওই শিক্ষার্থী তাঁকে সুন্দরবন থেকে তিনটি সুন্দরীগাছের চারা এনে দেন। একটি চারাও বাঁচাতে পারেননি মাহবুব। পরে ওই শিক্ষার্থী সুন্দরীগাছের বীজ এনে দেন তাঁকে। বহু সাধ্য-সাধনায় মাহবুব সেই বীজ থেকে সাতটি চারার মুখ দেখেন।

রীতিমতো গবেষণা
পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা মাহবুব। কর্মস্থল রাজশাহীতে। প্রতি শুক্র ও শনিবার বাড়ি যান। গাছগুলোর যত্ন-আত্তি করেন। সব মিলিয়ে তাঁর বাগানে বেড়ে উঠছে ১২৩ প্রজাতির গাছ। সুন্দরীগাছ টেকাতে মাহবুবকে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে। নানা রকমের মাটিতে তিনি এই বীজ রোপণ করলেন। কোনোটা বেলে মাটিতে, কোনোটি বেলে-দোঁআশ, কোনোটি এঁটেল মাটিতে, কোনোটি কাদামাটিতে রোপণ করলেন। পরে ভাবলেন, সুন্দরবনে জোয়ার-ভাটার মধ্যে এই গাছ হয়। তিনি ওপরে মাটির হাঁড়িতে পানি রেখে নিচে ফুটো করে খড় দিয়ে রেখেছিলেন, যাতে কিছুক্ষণ পরপর এক ফোঁটা করে পানি মাটিতে পড়ে। এ রকম সাধনায় কাদামাটিতে রোপণ করা নয়টি বীজ থেকে চারা গজায়। এখন সাতটি সুন্দরীগাছ তাঁর বাগানে বেড়ে উঠছে। এগুলোর বয়স আড়াই বছর। গাছগুলো তিন থেকে সাত ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়েছে। একইভাবে তাঁর বাগানে লাগানো গর্জন, তেলসুর ও বৈলাম এক বছর পর্যন্ত বাড়েনি। এ নিয়েও তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অবশ্য বছরখানেক পর গাছগুলো বাড়তে শুরু করে।

মাহবুবের বাগানে একদিন
সম্প্রতি তাঁর বাগানে গিয়ে বিচিত্র সব গাছ দেখে মুগ্ধ হতে হয়। একটি গাছের নাম সিঁদুর। এ গাছ থেকে সিঁথির সিঁদুর তৈরি হয়। একটি গাছের নাম পানমসলা। পাতা মুখে দিয়ে চমৎকার একটা স্বাদ পাওয়া গেল। আরেকটি গাছের নাম গান্ধীগজারি। দুর্গন্ধে আবার এ গাছের কাছে ঘেঁষা দায়। বুদ্ধনারকেলগাছের নামের সঙ্গে নারকেল কথাটি যুক্ত থাকলেও এটি আসলে নারকেল নয়। একধরনের ফল। পাখি ও মানুষ—সবাই খায়। চা ও কফিগাছও রয়েছে বাগানে। তিন ধরনের গর্জনগাছ আছে। তেলিগর্জন, ধলিগর্জন ও শ্বেতগর্জন। এদের মধ্যে শ্বেতগর্জন উপকূলীয় এলাকা ছাড়া হয় না।
দেখা গেল, দুর্লভ কিছু গাছ ঢাকিজাম, উড়িয়াম, সিভিট, মাইলাম, ভুঁইকদম, কন্যারী, বান্দরহুলা, গুডগুটিয়া, হুলদু, সিদাজারুল, রক্তন, রাতা, তুন, দুদকুরুজ, বিহদারুল, ধূপ, লোহা, লুকলুকি ইত্যাদি।
বাগানে ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় মাহবুবের সঙ্গে। গাছ সংগ্রহ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেন তিনি। একবার কক্সবাজারে মালমঘাট কুটাখালী ফরেস্টে গাছ আনতে গিয়ে ভুলবশত হাতি চলাচলের রাস্তায় ঢুকে পড়েছিলেন। তাঁর পেছনে হাতি এসে দাঁড়িয়ে ছিল। মালমঘাট ফরেস্টের একজন কর্মচারী তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন সেদিন। আবার বৃষ্টির সময় লাগালে গাছ বাঁচার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একবার বৃষ্টি মাথায় গাছ লাগানোর সময় তাঁর পাশেই বজ্রপাত হয়। এরপর প্রায় দেড় ঘণ্টা তিনি বাক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।
দুর্লভ গাছের বাগান করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাহবুবের ভাষ্য, তিনি এসব গাছের মাতৃগাছ তৈরি করতে চান। একসময় তিনি থাকবেন না। তাঁর বাগান থাকবে। যাঁরা এ ধরনের গাছ তৈরি করতে চান, তাঁরা তাঁর বাগান থেকে বীজ বা চারা নিতে পারবেন।

বাগান নিয়ে অন্যদের ভাষ্য
চট্টগ্রামের ষোলশহর বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বীজ সংগ্রহকারী সাইফুল ইসলাম। মাহবুবকে দুর্লভ কিছু গাছ দিয়েছিলেন। তিনি দুবার মাহবুবের বাগানে এসেছেন। তিনি বলেন, সুন্দরীগাছ সাধারণত সুন্দরবনেই হয়। এর বাইরে মাহবুবের বাগানেই তিনি প্রথম দেখেছেন।
আর নিসর্গবিদ মোকারম হোসেন জানান, সুন্দরীগাছ সাধারণত সুন্দরবনের পরিবেশে, লোনাজল ও জোয়ার-ভাটার মাটিতে হয়। শখ করে বা প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য কেউ অন্য এলাকায় করতে পারেন। যেমন মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে করা হয়েছে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনেও সুন্দরীর পাশাপাশি সুন্দরবনের কয়েক প্রজাতির গাছ রয়েছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ সদরের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কাশেম আগে রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। তিনিও মাহবুবের বাগান দেখেছেন। তাঁর মতে, উপকূলীয় লোনাজলের এলাকা ছাড়া যে গাছগুলো দেশের অন্য এলাকায় হয় না, সেই গাছের প্রতিই মাহবুবের ঝোঁক বেশি। দেশের অন্য কোথাও তিনি এ-জাতীয় গাছের বাগান দেখেননি।