রেলে সব আছে, শৃঙ্খলা নেই

প্রতি ইঞ্চি রেললাইন নিরাপদ এবং সঠিক কি না, তা দেখার লোক নিয়োগ করা আছে রেলে। প্রতিটি যাত্রার আগে ইঞ্জিন-কোচ নিরাপদ কি না, তাও নিশ্চিত করতে কয়েক স্তরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এরপরও রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হচ্ছে। বিশেষ করে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।

পরিকল্পিত নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকার কারণেই রেলকে নিরাপদ বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১১ বছরে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। নতুন লোকবল নিয়োগ হয়েছে ১৩ হাজারের মতো। এরপরও রেলে দুর্ঘটনা কমছে না।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, রেলে গত এক দশকে বড় প্রকল্পে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এর বেশির ভাগই নতুন রেললাইন নির্মাণের। প্রকল্পে ব্যাপক অপচয়েরও অভিযোগ আছে। ফলে পুরোনো রেললাইন জরাজীর্ণই রয়ে গেছে। লোকবল নিয়োগ হলেও তাঁদের ব্যবহার ঠিকঠাক হচ্ছে না। রেলে যাত্রীসেবা যেমন বাড়ছে না, তেমনি বাহন হিসেবেও পুরো নিরাপদ হয়নি।

গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুতির ঘটনায় পাঁচজন যাত্রী মারা গেছেন। আহত হন শতাধিক। এ ঘটনায় ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে ২২ ঘণ্টা। ছয়টি বগি, ওই এলাকার রেললাইন এবং একটি সেতুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রেলের একটি তদন্ত কমিটি এ ঘটনার জন্য লাইনের ত্রুটিকে দায়ী করেছে। এই ঘটনার দুই দিন আগে ২১ জুন গাজীপুরে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি চাকা লাইনচ্যুত হলে প্রায় চার ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।

রেলের হিসাবে, ২০১৪ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে ৮৬৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১১১ জন। আহত হন ২৯৮ জন। রেলের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যু কিংবা রেললাইনের পাশে থেকে অজ্ঞাত যেসব লাশ উদ্ধার করা হয়, সেটা রেলের হিসাবের মধ্যে নেই।

রেলের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ট্রেন লাইনচ্যুতি। আর বেশি মানুষ মারা গেছে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে যানবাহনের সংঘর্ষে।

গত সাড়ে পাঁচ বছরে ট্রেনের ৬৩৯টি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, যা মোট দুর্ঘটনার ৭৩.৬২ শতাংশ।

রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল বিনিয়োগ এবং নতুন লোকবল নিয়োগের পর লাইনচ্যুতির ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। হয় বিনিয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না, নতুবা ব্যবস্থাপনায় গাফিলতি আছে। 

>রেলে দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ট্রেন লাইনচ্যুতি বিপুল অর্থ ঢেলেও ট্রেনের লাইনচ্যুতি বন্ধ হচ্ছে না রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি, অনিয়ম

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদনেও রেলের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার রেলমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়, রেলের দুর্নীতির বড় উৎস কেনাকাটা। এর মধ্যে ওয়াগন, কোচ, ইঞ্জিন, ডেমু ট্রেন ক্রয় উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে করা রেলপথে ডাবল লাইন ও মিশ্র গেজের লাইন নির্মাণ প্রকল্পেও দুর্নীতি হয়েছে। রেলের নিয়োগেও অনিয়ম-দুর্নীতি বিপুল। এ ছাড়া রেলের কারখানাগুলোতে যন্ত্রাংশ ক্রয় ও পুরোনো যন্ত্রাংশ বিক্রির সময় ব্যাপক দুর্নীতির কথা জেনেছে দুদক। ঠিকাদারেরা চুক্তি অনুসারে রেললাইনে পাথর না ফেলেই বিল নিয়ে যান। এ থেকে রেলের কর্মকর্তারাও ভাগ পান।

এসব বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা খুবই বৈজ্ঞানিক। সবাই সবার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করলে লাইনচ্যুতি বা দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা খুবই কম। কুলাউড়ার দুর্ঘটনার পর মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় কারও গাফিলতি ছিল কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি রেললাইনে কী পরিমাণ খরচ হয়েছে, এর সঙ্গে বাস্তব অবস্থার মিল আছে কি না, তাও দেখা হবে। তিনি বলেন, রেলের বিনিয়োগের একটা বড় অংশ উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণে আরও জোর দেওয়া হচ্ছে।

দুদকের প্রতিবেদন সম্পর্কে সচিব বলেন, এসব অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে তাঁরা আগে থেকেই কাজ করছেন। এখন দুদকের সুপারিশ ধরে দুর্নীতি রোধে তাঁরা আরও তৎপর হবেন।

নিরাপত্তাব্যবস্থা কাজ করছে না
রেলপথের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার পরপর কর্মচারীদের একটি দল কাজ করে। যা ‘গ্যাং’ নামে পরিচিত। এই দলে আছেন কি–ম্যান, ওয়েম্যান, গ্যাং–ম্যানসহ নানা পদের কর্মচারী। কি–ম্যানের কাজ হচ্ছে তাঁর এলাকায় রেললাইনের এক পাশ ধরে দিনে একবার হেঁটে যাবেন। অপর পাশ দিয়ে ফিরে আসবেন। এ সময়ে লাইনে নাটবল্টু, ক্লিপ, ফিশপ্লেট ঠিক আছে কি না, তা পরীক্ষা করে ত্রুটি পেলে নিজে তাৎক্ষণিক সারবেন। না পারলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। লাইনে ঠিকভাবে পাথর থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ওয়েম্যান। তিনি লাইন সোজা আছে কি না, তাও দেখেন। কি–ম্যান ও ওয়েম্যানের কাজের তদারকি করেন গ্যাং–ম্যান। কয়েকটি গ্যাংয়ের দায়িত্বে থাকেন ম্যাট। এর ওপর পারমানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টরসহ (পিডব্লিউআই) নানা পদের কর্মকর্তা-প্রকৌশলী আছেন। এভাবে রেলে নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি স্তরে সুনির্দিষ্ট দায়িত্বে লোকবল রয়েছে। পিডব্লিউআইয়ের নেতৃত্বে, এমনকি আরও ওপরের কর্মকর্তাদের নিয়মিত ট্রলিতে করে রেলপথ পর্যবেক্ষণ করার কথা।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, রেলপথ নিরাপদ রাখার এই ব্যবস্থাই পুরোপুরি কাজ করছে না। পুরকৌশল বিভাগের অভিযোগ, তাদের লোকবলের অভাব আছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় মালামালও পাওয়া যায় না। অবশ্য রেলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বরাদ্দ ও লোকবলের বিষয়টি অজুহাত। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়েম্যান, কি–ম্যানসহ অপেক্ষাকৃত নিচের পদে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিপুল নিয়োগ হয়েছে। এসব পদে স্নাতক ডিগ্রিধারীরাও আছেন। ফলে তাঁদের অনেকেই লাইনে কাজ করতে আগ্রহী হন না। কারও কারও বিরুদ্ধে নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে ভাড়ায় করানোর অভিযোগ আছে। এই কর্মীরা তাঁদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে রেললাইনের প্রতি ইঞ্চি নিরাপদ থাকার কথা।

পুরোনো ইঞ্জিন-কোচ রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি-অনিয়ম
ট্রেন চলাচলের সার্বিক বিষয় নিয়ে কয়েক মাস পরপর বৈঠক হয়। এটাকে বলা হয় অপারেশনাল রিভিউ মিটিং (ওআরএম)। গত ২৭ জুন রেলের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে রেল ভবনে অনুষ্ঠিত ওআরএম বৈঠকে ইঞ্জিন-বগির রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার চিত্র উঠে আসে। বৈঠক সূত্র জানায়, রেলের পূর্বাঞ্চলে ২০ শতাংশ বগি বার্ষিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মেরামত ছাড়াই চলছে। লোকবলের অভাব এবং বগির স্বল্পতার কারণে এই কাজ হচ্ছে না। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজের ১২ শতাংশ এবং ব্রডগেজের ৮ শতাংশ বগি সময়মতো মেরামত হয়নি।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, একটি যাত্রীবাহী ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছালে এর ইঞ্জিন ও বগি ৪৫ মিনিট ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নিয়ম। এ সময় বগি ধোয়া-মোছা, কলকবজা পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু এই কাজে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ ছাড়া তিন মাস পরপর মেরামত কারখানায় নিয়ে বগির দিনব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিয়ম আছে। এক বছর পর কারখানায় নিয়ে বড় ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মেরামতের কথা। এসবের জন্য বরাদ্দও আছে। কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজটাই ঠিকভাবে হয় না।

একইভাবে ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে গন্তব্যে গিয়ে পরীক্ষার পাশাপাশি দেড় মাস পর কারখানায় নিয়ে পরীক্ষা করার কথা। এটাকে সি শ্রেণির পরীক্ষা বলে। এরপর তিন মাস পর ডি এবং ছয় মাস পর ই শ্রেণির মেরামত দরকার। রেলে ইঞ্জিনের সংখ্যা ২৭২। এর মধ্যে ১৯৫টি মেয়াদোত্তীর্ণ (সাধারণ বয়সকাল ২০ বছর)। অর্থাৎ ৭২ শতাংশই স্বাভাবিক বয়সসীমার বেশি। এর মধ্যে কোনো কোনোটার বয়স ৫০–এর ওপরে।

সর্বশেষ ওআরএম বৈঠকের তথ্য অনুসারে, গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে রেলের পূর্বাঞ্চলে ২৭ বার ইঞ্জিন বিকল হয়েছে। এর ফলে ট্রেন চলাচলে সার্বিক বিলম্ব হয়েছে ৬৪ ঘণ্টা। পূর্বাঞ্চলে মার্চ-এপ্রিলে ইঞ্জিন বিকল হয় ৯ বার। তবে এর জন্য ট্রেন বিলম্ব হয়েছে কত ঘণ্টা, তা উল্লেখ করা হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেলের প্রতিটি নাটবল্টু, পাত, ফিশপ্লেট, ক্লিপসহ রেললাইন নির্মাণের দিন যেমন থাকে, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে তা একই মানের রাখা জরুরি। নতুবা দুর্ঘটনা ঘটবেই। উন্নত বিশ্ব ছাড়াও আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ট্রেনের গতি সবচেয়ে কম। তাই ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতি বা দুর্ঘটনার পেছনে অবশ্যই রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি আছে। এই পরিস্থিতিতে গতি বাড়ানো হলে দুর্ঘটনা আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, রক্ষণাবেক্ষণে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি নেই, প্রকল্পে সেটা আছে। তাই বড় প্রকল্পে মনোযোগ বেশি। রক্ষণাবেক্ষণে দরদি লোক দরকার। নিয়োগে রাজনৈতিকীকরণ এবং ঘুষ-কমিশনের কারণে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।

সামছুল হক বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গতি ও নিরাপদ যাতায়াতের জন্য রেল সারা বিশ্বেই নির্ভরশীল সেবা। গতি বাড়ানো গেলে বর্তমানে যে সম্পদ আছে, তা দিয়েই যাত্রীসেবা পরিবহন ও সেবা কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। শুধু কেনাকাটায় টাকা খরচ না করে তাই রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগ দেওয়া উচিত।