'গেমঘরে' পাঁচজনের জন্য এক থালা ভাত

পেয়ার আলী
পেয়ার আলী

দিন–রাত মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় এক থালা ভাত; সঙ্গে এক চামচ ডাল। তবে এই খাবার একজনের জন্য নয়, আরও চারজনের সঙ্গে ভাগ করে খেতে হয়েছে পেয়ার আলীকে (২৮)। কোনো কোনো দিন খাবারই দিতেন না দালালেরা। লিবিয়ার ‘গেমঘর’-এ এভাবে কেটেছে এক মাস। এরপর ইউরোপে পৌঁছানোর আশায় স্পিডবোটে করে ভূমধ্যসাগর–যাত্রার কাহিনি আরও ভয়ংকর। শেষমেশ প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন, এতেই সন্তুষ্ট পেয়ার আলী।

পেয়ার আলীর বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের দুর্গাবদ্দী গ্রামে। তিউনিসিয়া থেকে গত ২১ জুন ফেরা ১৭ বাংলাদেশির একজন তিনি। সম্প্রতি দুর্গাবদ্দী গ্রামে গিয়ে পেয়ার আলীর সঙ্গে কথা হয়। কষ্টের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি শিউরে ওঠেন।

পেয়ার আলী অভাবী পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণির পর আর এগোয়নি। একই এলাকার বাসিন্দা রাসেল মীর লিবিয়ায় থাকেন। বাংলাদেশ থেকে সেখানে লোকজন নিয়ে যান। একপর্যায়ে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় পেয়ার আলীর। ‘দালাল’ রাসেলের কথামতো ঢাকায় আক্তার নামের এক দালালের সঙ্গে দেখা করেন পেয়ার আলী। লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে কাজ দেওয়ার শর্তে পাঁচ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন।

পেয়ার আলীকে পর্যটকের ভিসা দেওয়া হয়। গত ১৫ এপ্রিল প্রথমে বাংলাদেশ থেকে বিমানযোগে দুবাইয়ে যান। সেখানে বাংলাদেশি দালাল আক্তারের লোকজন তাঁকে গ্রহণ করেন। ১২ দিন পর কোনো ভিসা ছাড়াই তাঁকে তিউনিসিয়ার একটি উড়োজাহাজে তুলে দেওয়া হয়। তিউনিসিয়ার বিমানবন্দরে নামলেও বাইরে বের হতে পারেননি। সেখান থেকেই পেয়ার আলীকে লিবিয়ার উড়োজাহাজে তুলে দেওয়া হয়। লিবিয়ার বিমানবন্দরে তাঁকে গ্রহণ করেন রাসেল মীর ও তাঁর অনুসারীরা। সেখান থেকে একটি শিবিরে নিয়ে তাঁকে আটকে রাখা হয়। মুঠোফোনটি কেড়ে নেওয়া হয়।

পেয়ার আলী বলেন, বাড়ির লোকজন পুরো পাঁচ লাখ টাকাই বাংলাদেশে দালাল আক্তারকে দেন। একপর্যায়ে দালাল রাসেল জাহাজে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তাঁকে ইতালি যাওয়ার লোভ দেখান। এ জন্য বাড়তি তিন লাখ টাকা দিতে হবে আগেই। এ টাকা হাতে পাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় গেমঘরে।

>লিবিয়ার ‘গেমঘর’-এ কেটেছে এক মাস
এরপর স্পিডবোটে করে ভূমধ্যসাগর-যাত্রার কাহিনি আরও ভয়ংকর


রোজা শুরুর আগে ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজনকে দেওয়া হতো একবার এক থালা ভাত ও এক চামচ ডাল। রোজা শুরুর পর এক থালা ভাতে সাহ্‌রি সারতে হয় পাঁচজনকে। গেমঘরের এক মাসের জীবন সম্পর্কে পেয়ার আলী বলেন, ‘সেখানে অনেকে মারাও যায়। ওদের কথার অবাধ্য হলেই খাবার বন্ধ। এমনকি বেদম মারধর করত দালালেরা।’

২২ রোজার দিন পেয়ার আলীসহ গেমঘরের ৭৫ জনের ডাক আসে। তাঁদের বলা হয়, আজ গেম হবে। অর্থাৎ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যেতে হবে। রাতের আঁধারে ২২ কিলোমিটার হাঁটিয়ে নেওয়া হয় সাগর উপকূলে। পেয়ার আলীরা জানতেন, জাহাজে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেবেন। ওখানে গিয়ে দেখা গেল, ছোট দুটি স্পিডবোট। কেউই স্পিডবোট উঠতে রাজি নন। এ সময় দালালেরা গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়ে তাঁদের স্পিডবোটে ওঠান।

সারা রাত চলার পর ভোরে স্পিডবোট দুটি লিবিয়ার জলসীমা ছাড়ায়। এ সময় ৭৫ জনকেই একটি স্পিডবোটে তোলা হয়। অন্যটির দখল নেন দালাল রাসেল মীর ও তাঁর তিন সহযোগী গোপালগঞ্জের বুলেট, ফরিদপুরের মুমিন ও লিবিয়ার নাগরিক অলিদ। স্পিডবোটের চালককে একটি মানচিত্র ধরিয়ে দিয়ে ইতালি যেতে বলেন দালালেরা। 

পেয়ার আলী প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন, এতেই খুশি পরিবার। তবে দুশ্চিন্তা আছে ঋণের টাকা নিয়ে। প্রথমে জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল পরিবার। পরের তিন লাখ টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন।

রাজৈর থানার ওসি মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, এক বছরে পুরো মাদারীপুরে মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে চারটি। তবে পেয়ার আলীর ঘটনায় যেসব দালালের নাম এসেছে, তাঁদের কেউ এসব মামলার আসামি কি না, নিশ্চিত হওয়া যায়নি।