'যদি একটু পানি খেয়ে মরতে পারতাম'

নিয়ামত শিকদার
নিয়ামত শিকদার

একটি স্পিডবোটে ৬৪ জনকে সাগরে রেখে দালালেরা পালিয়ে যান। সাগরে তিন দিন তিন রাত কেটে যায়। খাবার ও পানি ফুরিয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় বাঁচার আশাও। তৃষ্ণায় প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা নিয়ামত শিকদারের (১৮)। তখন ভাবেন, যদি একটু পানি খেয়ে মরতে পারতাম!

তিউনিসিয়া থেকে গত ২১ জুন ফিরে আসা নিয়ামত শিকদারের (১৮) বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার হিরাপুর গ্রামে। তিনি এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার আগেই মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েন এবং রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে দেশ ছাড়েন।

ইউরোপে পাড়ি জমাতে রফিকুল ইসলাম ওরফে সেলিম (৪৫) নামের এক ‘দালালের’ সঙ্গে ১৪ লাখ টাকার চুক্তি হয় নিয়ামতের। জমি বিক্রি করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ও স্বজনদের কাছ থেকে ধার করে সাড়ে ৯ লাখ টাকা এনে দেন। রফিকুলের বাড়ি আখাউড়ার মনিয়ন্দ ইউনিয়নের মোগড়ার ষোলঘর গ্রামে।

নিয়ামত চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ের শারজা বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে দালাল চক্রের সদস্যরা তাঁকে বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি বাসায় তিন দিন রাখেন। নিয়ামত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক রাতে দালালেরা আমাদের পাঁচজনকে বিমানবন্দরে নিয়ে যান। লিবিয়ায় পাঠানো হয়। বেনগাজি বিমানবন্দরে নামার পর সিলেটের বিয়ানীবাজারের মো. জাহিদ নামের এক দালাল মুঠোফোন, পাসপোর্ট ও আমার ২০০ ডলার ছিনিয়ে নেন। এর পর বাসে করে একটি ক্যাম্পে নেওয়া হয়। একতলা ভবনের ওই ক্যাম্পে আমিসহ ৫৬ জন ছিলাম ১৫ দিন। সকালে রুটি, রাতে ভাত আর আধা লিটার পানি দেওয়া হতো।’ 

>নিয়ামত এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার আগেই মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে স্বপ্নে বিভোর হয়ে দেশ ছাড়েন।

১৫ দিন পর নিয়ামতসহ তিনজনকে কালো গাড়িতে করে মরুভূমির একটি ঘরে নেওয়া হয়। সেখানে দালাল সেলিমের সঙ্গে নিয়ামতের দেখা হয়। এক দিন পর সেখান থেকে পিকআপ ভ্যানে তুলে মরুভূমির এক নির্জন ক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেখানে নিয়ামতসহ ৬৪ জন অন্তত তিন মাস ছিলেন। সেখানে দিনে আধা লিটার পানি, সকালে শুকনো খাবার ও রাতে রুটি আর মাঝেমধ্যে ভাত দেওয়া হতো। মাদারীপুরের রাসেল নামের একজন দালাল পাহারায় থাকতেন। নিয়ামত বলেন, রাসেলসহ লিবিয়ার ছয়-সাতজন দালাল সব সময় পিস্তল রাখতেন। রাসেল ও অলিদ নামের লিবিয়ার দালাল সবাইকে মারধর করতেন। চিৎকার বা উচ্চ স্বরে কথা বললেই পেছন থেকে হাত বেঁধে অন্ধকার একটি কক্ষে তালা দিয়ে রাখা হতো। কোনো খাবার দিত না।

নিয়ামতের ভাষায়, ‘রমজান মাসের শেষের দিকে আমাদের দুটি স্পিডবোটে তোলা হয়। ১৫-২০ ঘণ্টা চলার পর ইউরোপের জলসীমানায় পৌঁছার কথা বলে দুটি বোটের সবাইকে একটি বোটে তোলা হয়। অন্য বোটটি নিয়ে দালালেরা পালিয়ে যান। এভাবে তিন দিন তিন রাত কেটে যায়। খাবার নেই, পানি নেই। বাঁচার আশাও নেই। অনেকেই তখন বলত, আমরা ডেথ। জানাজা পর্যন্ত হবে না। খুব পানির পিপাসা লাগে। এরপর ১০-১৫ জন সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি। একটি তেলের ড্রাম ছিল, আমরা দড়ি দিয়ে ওই ড্রাম ধরে রাখি। তিন থেকে চার ঘণ্টা পর তিউনিসিয়ার একটি জাহাজ এসে আমাদের উদ্ধার করে।’

নিয়ামতের দুলাভাই মেহেদী হাসান বলেন, ‘গত বছরের শেষের দিকে দালাল সেলিমের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে সময় সেলিম সপরিবারে জেলা শহরের খয়াসার মার্কাজ মসজিদের পূর্ব পাশের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। আমার ভাগনে ও শ্যালককে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন সেলিম। এ ঘটনায় এখনো মামলা করা হয়নি।’

জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ডিআইও-১) ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, গত এক বছরে জেলায় মানব পাচার আইনে ১৩টি মামলা হয়েছে।