মূল ইয়াবা পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি
ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি

আশরাফ আলী ও মো. হাছান নামের দুই বাহককে গত বছরের ৩ মে ১৩ লাখ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাশেদ ওরফে মুন্না নামের আরেক বাহককে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৫ দিন পর আশরাফ ও রাশেদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে বাংলাদেশে শীর্ষ ইয়াবা পাচারকারী মিয়ানমারের নাগরিক আবদুর রহিম ও লা-লিম তাঁদের সহযোগী টেকনাফের শহীদ ও চট্টগ্রামের শওকতসহ ১৬ জনের নাম উঠে আসে। 

এরপরও নগর ডিবি পুলিশ ছয় মাস আগে আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে সঠিক নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় রহিমসহ ওই চার পাচারকারীর নাম বাদ দেয়। আদালত তা গ্রহণ না করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। পিবিআইও পাচারকারীদের ঠিকানা বের করতে না পেরে ডিবি পুলিশের পথে হাঁটে। ১ জুলাই পিবিআই চট্টগ্রাম আদালতে নগরের হালিশহর থানায় করা ওই মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবা পাচারকারীদের মধে৵ শীর্ষে রয়েছেন আবদুর রহিম। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা যত দিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন, তত দিন ইয়াবা পাচার বন্ধ হবে না। 

চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শুধু বাহককে আসামি করলে ইয়াবার বিস্তার রোধ হবে না। আদালতের নির্দেশের পরও পুলিশ পাচারকারীদের শনাক্ত করতে না পারার কারণটি খতিয়ে দেখা উচিত। গ্রেপ্তার আসামিরাই পাচারকারীদের সম্পর্কে জবানবন্দিতে তথ্য দিয়েছেন। এগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করলে পাওয়ার কথা। মামলাটি আবার তদন্তে পাঠাতে আজ আদালতে আবেদন করা হবে।

জবানবন্দিতে যা আছে

আদালত সূত্র জানায়, গত বছরের ১৯ মে জবানবন্দিতে আশরাফ জানান, কয়েক বছর আগে শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে যান তিনি। সেখানে পরিচয় হয় মিয়ানমারের বাসিন্দা আবদুর রহিমের সঙ্গে। রহিম তাঁকে জানান, তিনি ইয়াবার ব্যবসা করেন। বাংলাদেশে তাঁর হয়ে কাজ করেন জুবায়ের, রাশেদ ওরফে মুন্না। জুবায়েরের সঙ্গে আছেন টেকনাফের শহীদ, আনোয়ারার আলী ওরফে আকবর, কামরুল ইসলাম, সুমন, আনোয়ার হোসেন ও হাটহাজারীর মো. শওকত।

কথামতো উড়োজাহাজে করে (৭ এপ্রিল) মিয়ানমারে গেলেও আশরাফ ফিরে আসেন সাগরপথে, ট্রলার ও স্পিডবোটে করে। ইয়াঙ্গুন থেকে ১৩ লাখ ইয়াবা বড়ি নিয়ে আসেন তিনি। বাহক হিসেবে এর জন্য তাঁর ২০ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। এই ইয়াবার মালিক কক্সবাজারের সাইফুল করিম (বন্দুকযুদ্ধে নিহত) ও টেকনাফের জুবায়ের ওরফে রেদোয়ান। ইয়াঙ্গুন থেকে এদের জন্য ইয়াবার চালানটি পাঠান রহিম। 

জবানবন্দিতে আরেক আসামি রাশেদ বলেন, ইয়াঙ্গুনের আবদুর রহিম তাঁর ফুপাতো বোনের স্বামী। রহিম ১০ বছর ধরে ইয়াবা ব্যবসা করেন। তিনি বাংলাদেশে এলে শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা জুবায়েরের বাড়িতে ওঠেন। জুবায়েরের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় ১০-১২টি ইয়াবার চালান পাঠিয়েছেন। জুবায়ের ছাড়াও টেকনাফের বাসিন্দা সাইফুল করিম ইয়াঙ্গুন থেকে রহিমের কাছ থেকে সাত-আটটি ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন। 

গতকাল টেকনাফ সদরের মৌলভিপাড়ায় জবানবন্দিতে নাম আসা শহীদের খোঁজ নিলে স্থানীয়রা জানান, এখানে অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী থাকলেও হামিদের ছেলে শহীদ নামের কেউ নেই। একইভাবে হাটহাজারীর মাদার্শা গ্রামে শওকত নামের কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ী নেই জানান থানার ওসি বেলাল উদ্দিন জাহাংগীর। সূত্র জানায়, পাচারকারীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে গ্রেপ্তার আসামিরা কখনো কখনো ছদ্মনাম বলে থাকেন।

ডিবি পুলিশের তদন্ত

জবানবন্দিতে আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো উল্লেখ করে আট মাস তদন্ত শেষে নগর ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক ফরহাদ হোসেন গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এতে আশরাফসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। ঠিকানা না পাওয়ায় বাদ দেওয়া হয় পাচারকারী রহিমসহ চারজনকে।

এটি গ্রহণ না করে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মো. আল ইমরান খান স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন পিবিআইকে। আদেশে বলা হয়, পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত না করায় ইয়াবা পাচারকারী আবদুর রহিমসহ অন্যদের শনাক্ত করতে পারেনি। এদের শনাক্ত করা হোক। 

পিবিআইর তদন্ত 

ছয় মাস তদন্ত শেষে আবদুর রহিমসহ চারজনকে বাদ দিয়ে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা স্বীকার করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক এনায়েত কবীর প্রথম আলোকে বলেন, নানাভাবে চেষ্টা করেও সঠিক নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় চারজনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। 

পাচারকারীরা গ্রেপ্তার আসামিদের পূর্বপরিচিত ও আত্মীয়, মুঠোফোনে তাঁদের নিয়মিত কথা হতো, এরপরও কেন ঠিকানা পাওয়া যায়নি প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, চেষ্টা অব্যাহত আছে।