শিশুর প্রতি হিংস্রতা বাড়ছেই

চলতি বছরের প্রথমার্ধে গড়ে মাসে অন্তত ৪৩টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অথচ গত বছর এই হার ছিল এর অর্ধেকের মতো। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, বিচারহীনতা, সামাজিক-পারিবারিক জটিলতা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নিয়মিত মানবাধিকার প্রতিবেদনে শিশু ধর্ষণের এ হিসাব পাওয়া গেছে। নয়টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদ এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আসক প্রতি মাসে এমন প্রতিবেদন তৈরি করে।

আসকের হিসাবে, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৬৩০টি। এগুলোর অর্ধেকের মতো ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স বলা আছে। দেখা যায়, তাদের সিংহভাগেরই বয়স ১৮ বছর বা তার নিচে। আর ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা।

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, চলতি বছরের ধারাটি উদ্বেগজনক। সব দিক থেকে প্রতিকার-প্রতিরোধের কাজ হওয়া দরকার। তেমনটা হচ্ছে খুব কম। চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলে, গণমাধ্যম সোচ্চার হলে প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ কয়েক দিন দৌড়ঝাঁপ করে। তারপর সব থিতিয়ে যায়। ঘটনা কিন্তু বেড়ে চলছে। সহিংসতা ও হিংস্রতাও বাড়ছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা একেবারেই নিশ্চিত করতে পারিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, মাদকাসক্তি, শিশু-কিশোরদের আচরণগত সমস্যাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় এমন ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। সমাজে প্রকৃত যৌনশিক্ষার অভাব রয়েছে।’ তাঁর মতে, শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

আসকের হিসাবে, গত ছয় মাসে শিশু ধর্ষণের মোট ঘটনা সংখ্যায় ২৫৮। তুলনায় ২০১৮ সালের ১২ মাসে ঘটেছিল ২৭১টি। গত বছর ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ফলে শিশু হত্যার ঘটনা ছিল ৩৫টি।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাবে, গত ছয় মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা আরও বেশি—মাসে গড়ে প্রায় ৮৩টি। গত বছর এই হার ছিল এর প্রায় অর্ধেক। শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি ১৫টি পত্রিকার খবর গণনা করে।

শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগের দায়িত্বে থাকা উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে ঘরের ভেতরে, আপনজনদের মাধ্যমে। সব ধর্ষণের ঘটনায় মামলাও হচ্ছে না। পুলিশ শিশু ধর্ষণের তদন্তকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সারা দেশে শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩০০-এর কিছু বেশি। আর গত পাঁচ বছরে মোট শিশু ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি। আসক গত পাঁচ বছরে ধর্ষণের শিকার যত মেয়ের বয়সের হিসাব দিয়েছে, তাদের প্রায় ৯০ শতাংশই শিশু-কিশোরী।

গত শুক্রবার রাজধানীর ওয়ারীর নির্মাণাধীন একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় সাত বছরের শিশু সামিয়া আফরিন সায়মার লাশ। পুলিশ বলেছে, সায়মাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। আসামি দ্রুতই গ্রেপ্তার হয়েছে। গত ২৭ জুন ১২ জন শিশুছাত্রীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল-আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-১১।

ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে চলেছে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, শিশু নির্যাতন বাড়ার পেছনে বিচারহীনতা ও বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ করেও অপরাধী ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয় না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও তারা বিচার ও শাস্তি এড়িয়েই চলতে পারে।

প্রথম আলো ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১৫ বছরে (২০০২-১৬) আসা ধর্ষণসংক্রান্ত পাঁচ হাজারের মতো মামলার পরিস্থিতি অনুসন্ধান করে দেখতে পেয়েছে, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে।

আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ গবেষক রুচিরা তাবাসসুম নভেদ্ দীর্ঘদিন ধরে যৌন সহিংসতাসহ নারী নির্যাতন নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর মতে, এ সমাজ ক্ষমতাধরদের দুর্বলকে নিপীড়নের সুযোগ করে দিচ্ছে বলেই অপরাধের সাজা কম হচ্ছে। নারী, পুরুষ বা শিশুনির্বিশেষে ক্ষমতা ও অবস্থানে বৈষম্যের যে মানসিকতা, সেটা দূর না হলে যৌন নির্যাতনের শিকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে না।

>২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৬৩০টি
ভুক্তভোগীর সিংহভাগের বয়স ১৮ বছর বা তার নিচে
ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ২১টি
ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি ৭–১২ বছর বয়সী শিশুরা
শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের চলতি ধারাটি উদ্বেগজনক

প্রতিকার-প্রতিরোধে সরকার আসলে কী করছে, ঘুরেফিরে তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘মাল্টি-সেক্টরাল কর্মসূচি’ নামে পরিচিত একটি কার্যক্রম আছে। এর পরিচালক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে উঠান বৈঠক, সচেতনতামূলক কর্মসূচি, সেমিনারসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চলে। সেখানে একটি অংশ থাকে ধর্ষণ প্রতিরোধবিষয়ক। তবে নির্দিষ্টভাবে ধর্ষণ প্রতিরোধে কোনো কর্মসূচি নেই।

আবুল হোসেন বলেন, সহিংসতার আশঙ্কা থাকলে বা সহিংসতার শিকার হলে ‘১০৯’ হেল্পলাইনে কল করলে সহায়তা পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় চাঞ্চল্যকর নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলোর ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তা দ্রুত নিষ্পত্তির তাগিদ দিয়ে চিঠি পাঠায়।

তবে সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধিদের মতে, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বা ঘটনা ঘটার পর সরকারের তৎপরতা খুবই অপ্রতুল।

শিশুদের অধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদনে শিশু অধিকার ফোরাম ধর্ষণ বন্ধের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। সংগঠনটি যৌন নির্যাতনসহ বেশ কিছু নির্যাতন প্রতিরোধে মা-বাবার সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ছাড়া সংগঠনটি বলছে, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির রায় দ্রুত কার্যকর করতে হবে।

ধর্ষণকে শিশুদের জন্য চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, আইনের বাস্তবায়ন ও অপরাধীর শাস্তি হওয়ায় অ্যাসিড-সন্ত্রাস আগের চেয়ে অনেক কমেছে। ধর্ষণের অপরাধীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, এখন অপরাধ করেও প্রভাবশালী, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিসম্পন্নরা পার পেয়ে যায়, ফলে ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ জানাতেও ভয় পায়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও সেভাবে দেখি না। শিশু ধর্ষণকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—তিন জায়গাতেই কাজ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।