ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাতের আঁধারে পুকুর ভরাট

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের কোর্টরোড এলাকায় প্রভাবশালীরা আইন অমান্য করে বালু ফেলে পুকুর ভরাট করছেন। গত সোমবার দুপুরে। প্রথম আলো
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের কোর্টরোড এলাকায় প্রভাবশালীরা আইন অমান্য করে বালু ফেলে পুকুর ভরাট করছেন। গত সোমবার দুপুরে। প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অমান্য করে পুকুর ভরাট করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাতের আঁধারে ট্রাক্টরে করে বালু এনে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব স্বাক্ষরিত এক নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর জেলা শহরের কোর্ট রোড এলাকার গোলাপ রেস্টহাউস–সংলগ্ন পুকুর ভরাটের মৌখিক অভিযোগ পায় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হাসান আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ৬০ শতক ওই পুকুরের প্রায় অর্ধেক বালু দিয়ে ভরাট করার দৃশ্য দেখতে পান। গত বছরের ১৫ মার্চ পুকুরের ভরাট প্রসঙ্গে গোলাপ মিয়া ও জাহাঙ্গীর কবিরের ছেলে সোহেল কবীরকে শুনানির নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই বছরের ২২ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তরে সশরীরে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)–এর উপধারা ৬ (ঙ) অনুযায়ী পুকুর ভরাট করায় গোলাপ ও সোহেলের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, এর লিখিত জবাব দিতে বলা হয়। কিন্তু তাঁরা কেউই যাননি। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর তাঁদের বিরুদ্ধে আর কোনো নোটিশ দেয়নি কিংবা তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। 

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৬ (ঙ) অনুযায়ী, জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর ভরাট না করার বিধান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাধার বা পুকুর ভরাট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ভরাটকারীর বিরুদ্ধে আইনের ৭ ধারায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে। 

জানা গেছে, গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী হাকিম জুবায়ের হোসেন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের রিসার্চ কর্মকর্তা রুনায়েত রেজা ঘটনাস্থলে যান। এ সময় পুকুর ভরাট কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা ফারুক মিয়া ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়েন। পরে বেলা সোয়া একটার দিকে সরকারি এই কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। 

জানা গেছে, কোর্ট রোডের পুকুর–সংলগ্ন এলাকায় অমরেন্দ্রনাথ লাল রায়সহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ১১ জনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন দাগে প্রায় সাড়ে ১০ শতক জায়গায় প্রায় ৭০ বছর ধরে ভোগদখল করে আসছেন। সম্প্রতি গোলাপ ও জাহাঙ্গীর সেখানে পুকুর ভরাট করে নির্মাণকাজ করতে গেলে ব্যবসায়ীরা বাধা দেন। ২৯ জুন গোলাপ, জাহাঙ্গীরসহ তাঁদের লোকজন ওই ১১ ব্যবসায়ীকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখান এবং যেকোনো সময় জায়গা জোরপূর্বক দখল করার হুমকি দেন। পরে ৩০ জুন অমরেন্দ্রনাথ লাল রায়সহ ১১ জন ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা হাকিমের আদালতে ১৪৪ ধারা জারির জন্য আবেদন করেন। অভিযোগে গোলাপ মিয়া ও জাহাঙ্গীর মিয়ার (জাহাঙ্গীর কবির) নাম উল্লেখ করা হয়। আরজিতে উল্লেখ করা হয়, তাঁদের দলিলমূলে চৌহদ্দিতে কোর্ট রোডের ওই জায়গার দক্ষিণ দিকে পুকুর রয়েছে। কিন্তু সদর উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্বে থাকা সোহেল রানা ও সদর ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম গত বছরের ২৪ জুলাই স্বাক্ষরিত ৫৩২৪ নম্বর খতিয়ানের ১৯৭২ দাগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মৌজার ওই জায়গাটির শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুর হালে ভিটি দেখিয়েছেন। সেখানে ৪৯ শতকের মধ্যে ১৭ দশমিক ১৬ শতক জায়গার মালিক জাহাঙ্গীর। সিএস খতিয়ানে একই জায়গার ৭৬ শতক এবং এসএ খতিয়ানে ৮৯ শতক পুকুর রয়েছে। 

সদর ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, কোর্ট রোডের একটি দাগে হিন্দু সম্প্রদায়ের জায়গা রয়েছে। সেখানে এসএ খতিয়ানে পুকুর রয়েছে। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের রিসার্চ কর্মকর্তা রুনায়েত রেজা বলেন, জায়গাটি অবশ্যই পুকুর। এখানে গোলাপ রেস্টহাউস ছিল বলে ভরাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন। আর তাঁরা জায়গাটির পুকুর থেকে শ্রেণি পরিবর্তন ভিটি করেছেন। তা আইনত দণ্ডনীয় একটি কাজ। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগেও বালুর পরিমাণ কম ছিল। বালু ফেলে অনেক দূর ভরাট করা হয়েছে। পুকুরটি ভরাট থেকে বিরত থাকার জন্য সেখানে একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো হবে। 

সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী হাকিম জুবায়ের হোসেন বলেন, ভরাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত মালিকপক্ষকে না পাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যায়নি। তবে কোনোভাবেই এই পুকুর ভরাট করতে দেওয়া হবে না। জেলা প্রশাসক বিষয়টি নজরে রাখছেন।