দালালেরা অস্ত্র উঁচিয়ে হুংকার দিয়ে বলে, 'ওঠ স্পিডবোটে'

রাসেল মাতুব্বর
রাসেল মাতুব্বর

দালালেরা বলেছিলেন, জাহাজে করে ভূমধ্যসাগর পার করে ইতালি পৌঁছে দেবেন। কিন্তু সামনে দুটি স্পিডবোট হাজির। ৭৫ জনকে তাতে উঠতে বলা হলো। কেউই তাতে রাজি নন। সামনে সীমাহীন জলরাশি। পেছনে অস্ত্র উঁচিয়ে দালালদের হুংকার, ‘ওঠ স্পিডবোটে। নয়তো এখানেই মরে পড়ে থাকবি।’ ভয়ে ভয়ে স্পিডবোটে উঠে পড়েন রাসেল মাতুব্বরসহ সবাই। এরপর উদ্ধার হওয়ার আগে সাগরে অনাহারে-অর্ধাহারে চার দিন কাটে তাঁদের।

রাসেল মাতুব্বর (২৯) মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আপাসী এলাকার মোখলেস মাতুব্বরের ছেলে। সম্প্রতি তিউনিসিয়া থেকে ফেরা ১৭ বাংলাদেশির একজন তিনি। ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে লিবিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে পড়েন বাংলাদেশি এক দালালের খপ্পরে। রাসেলকে কম খরচে ইতালি যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিলেন ওই দালাল। এরপর টানা প্রায় পাঁচ মাস কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করে জীবনটা নিয়ে কোনোমতে দেশে ফিরেছেন। সম্প্রতি রাসেলের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

দেশে রাসেলের ছোট্ট একটি দরজির দোকান ছিল। সেখানে আসা-যাওয়া করতেন গাছবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন। রাসেলকে তিনিই কম খরচে লিবিয়ায় যাওয়ার কথা বলেন। প্রথমে রাজি হননি। একপর্যায়ে নাসিরের কথামতো পাসপোর্ট করেন। এরপর দেড় মাসের মধ্যেই অবৈধ পথে লিবিয়ায় বন্দোবস্ত করে ফেলেন দালালেরা। চুক্তি হয় লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে কোনো টাকা দিতে হবে না; পৌঁছে গেলে একসঙ্গে দিতে হবে ৫ লাখ টাকা।

২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাসেলকে পর্যটক ভিসায় দুবাই পাঠানো হয়। সেখানে রমজান নামের এক দালালের তত্ত্বাবধানে ১৫ দিন থাকেন। এরপর অবৈধভাবে রাসেলকে তিউনিসিয়ায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন রমজান। তবে সেখানে বিমানবন্দর থেকে বের হতে দেননি দালালেরা। তিউনিসিয়ার ওই বিমানবন্দর থেকে একই প্রক্রিয়ায় রাসেলকে লিবিয়ার বিমানে তুলে দেওয়া হয়। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরপরই তাঁকে দালালের মাফিয়া বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। চুক্তির ৫ লাখ টাকা বাংলাদেশে দালালদের নিযুক্ত লোকজনকে দেওয়ার পরই মুক্তি মেলে।

>

রাসেল মাতুব্বর মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা। সম্প্রতি তিউনিসিয়া থেকে ফেরা ১৭ বাংলাদেশির একজন তিনি।

রাসেল খোঁজ করে ত্রিপোলিতে পরিচিত কয়েকজনের সন্ধান পান। তাঁরাই রাসেলকে নির্মাণশ্রমিকের কাজ জোগাড় করে দেন। এক মাসের মতো কাজ করেন। একপর্যায়ে যোগাযোগ হয় মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার দুর্গাবদ্দী এলাকার বাসিন্দা রাসেল মীরের সঙ্গে। তিনি রাসেলকে ইতালি যাওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু নানাভাবে ফুসলাতে থাকেন দালাল রাসেল মীর। বলেন, লিবিয়াতে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি হয়ে যেতে হবে। এমনকি তাঁদের হাতে মৃত্যুও হতে পারে। তার চেয়ে একটু কষ্ট হলেও ইতালিতে যাওয়া ভালো।

রাসেল মাতুব্বর বলেন, ‘রাসেল মীর আমার জেলারই মানুষ। নানাভাবে আমাকে ভরসা দিচ্ছিলেন। ভেবে দেখলাম, মাফিয়াদের হাতে মরার চেয়ে ইতালি যাওয়ার সুযোগ নিই। একবার যেতে পারলে ভাগ্যের চাকা খুলে যাবে। পরে বাড়িতে জানাই। তারা ধারদেনা করে আড়াই লাখ টাকা পাঠায়। টাকা দেওয়ার পর দালাল রাসেল আমাকেত্রিপোলির নির্জন এলাকার একটি বাড়িতে নিয়ে যান।’

গেমঘরে কোনো আলো-বাতাস নেই। পর্যাপ্ত খাবার দূরের কথা, পানির জন্যও হাহাকার। কথা বললেই নির্যাতন। চার মাসের বেশি সেখানে ছিলেন রাসেল মাতুব্বরসহ অন্যরা। ২২ রোজার দিন দালালেরা বলেন, আজ ‘গেম’ হবে। অর্থাৎ সাগরযাত্রা শুরু। রাতের আঁধারে ২২ কিলোমিটার হাঁটিয়ে উপকূলে নেওয়া হয় ৭৫ জনকে। কথা ছিল, বড় একটা জাহাজে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া হবে। কিন্তু রাসেল মাতুব্বরদের সামনে হাজির ছোট্ট দুটি স্পিডবোট। কেউই তাতে উঠতে রাজি নন। এবার দেখা গেল দালালদের আরেক রুদ্রমূর্তি। অস্ত্র উঁচিয়ে ধরলেন তাঁরা। হুংকার দিয়ে বললেন, ‘ওঠ স্পিডবোটে। নইলে গুলি করব। সাগরপারেই সবাই মরে পড়ে থাকবি।’