নারায়ণগঞ্জে নানা সংকটে ৭৫৫ জন শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়

বিদ্যালয় ভবনের ছাদের খসে পড়া পলেস্তারা পরিষ্কার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক ছবি।  প্রথম আলো
বিদ্যালয় ভবনের ছাদের খসে পড়া পলেস্তারা পরিষ্কার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক ছবি। প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার লক্ষ্মী নারায়ণ বালক–বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরোনো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভবনের ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই ছাদ থেকে পানি চুইয়ে পড়ে। ফাটল ধরেছে ভবনের বিম, কলাম ও বিভিন্ন দেয়ালে। এ অবস্থায় ছাদ বা পুরো ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কার মধ্যেই চলছে পাঠদান।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদ্যালয়টির দোতলা ভবনের বারান্দা ও শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন জায়গার বিম ও কলামে ফাটল দেখা দিয়েছে। ছাদের কোথাও কোথাও পলেস্তারা খসে রড বেরিয়ে পড়েছে। ছাদ থেকে পানি চুইয়ে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে একটি কক্ষের দেয়াল। শিক্ষার্থী অনুপাতে শ্রেণিকক্ষ কম হওয়ায় গাদাগাদি করে বসে পড়াশোনা করছে ছাত্রছাত্রীরা। বিদ্যালয় ছুটির পর দেখা যায়, একজন শিক্ষক বেত হাতে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিঁড়িটা সরু এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বাচ্চারা একসঙ্গে নামলে এটা ভেঙে পড়তে পারে। তাই বাড়তি সতর্কতার জন্য তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

কথা হয় বিদ্যালয়ের প্রভাতি শাখার প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়, ভবনটি কখন জানি ভেঙে পড়ে। প্রতিদিন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই ছেলেমেয়েরা এখানে লেখাপড়া করে। একসময় ভবনের ছয়টি কক্ষে শ্রেণি কার্যক্রম চলত। চার বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দুটি কক্ষ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এরপর থেকে জায়গার সংকট শুরু হয়। একদিকে জীবনের ঝুঁকি, অন্যদিকে স্থানসংকট—এ নিয়েই তাঁদের পাঠদান চলছে।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শুভ্রা গায়েন বলেন, ভবনটি পুরোনো হওয়ায় এর কক্ষগুলোতে বেশি জানালা নেই। বিদ্যুৎ না থাকলে অন্ধকারের কারণে ক্লাস বন্ধ থাকে। এ ছাড়া জায়গার অভাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস করানো যায় না। কিছুদিন আগেও ক্লাস চলাকালীন বারান্দার ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে। ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে আসতে ভয় পায়।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে এলজিইডি বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দুটি কক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে তারা। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ভবনের অন্য চারটি কক্ষে ঝুঁকি নিয়েই দুই পালায় ৭৫৫ জন শিক্ষার্থীর পাঠদান চলছে। সূত্রটি আরও জানায়, ১৯৩৭ সালে চার শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে বিদ্যালয়ের দখলে আছে মাত্র আড়াই শতাংশ জমি। অবশিষ্ট জমির এক শতাংশ ভূমিদস্যুরা দখল করে রেখেছে, বাকি অংশ সড়কে চলে গেছে। দখল জমি উদ্ধার নিয়ে মামলা চলছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এসে ভবনের দুরবস্থা দেখে গেছেন। তবে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে বলে জানান দিবা শাখার প্রধান শিক্ষক তাপসী সারা।

বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সীতা রানী বলে, কিছুদিন আগে ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছিল। এরপর তার বাবা আগামী বছর তাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করানোর কথা বলেছেন।

বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মাসুম মিয়া বলেন, নিরাপত্তা বা শিক্ষার পরিবেশ—কোনোটাই এখানে নেই। বর্তমান সময়ে এসেও বিদ্যালয়ের ভবন এমন থাকাটা লজ্জাজনক।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনিরুল হক বলেন, ‘ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ক্লাস করাতে বাধ্য হচ্ছি। বিদ্যালয়ের জমি অন্যের দখলে থাকায় সরকারি নকশা অনুযায়ী নতুন ভবন নির্মাণ করার মতো জায়গা বিদ্যালয়টিতে নেই। এলজিইডি মাটি পরীক্ষা করেছে, কিন্তু জায়গার অভাবে ভবন করা যাচ্ছে না। এলাকাবাসী ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি জায়গার সমাধান করলে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে।’

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাজমুল আলম বলেন, ‘আমাদের দেশে বড় দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত কোনো কিছুর সমাধান হয় না। এলাকাবাসীকে নিয়ে বারবার জমি উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। শিক্ষা কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেছি যেকোনোভাবে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে কিংবা বিদ্যালয়টি অন্যত্র স্থানান্তর করতে। বর্তমানে জমি উদ্ধারের জন্য আন্দোলনের কথা ভাবছি।’